চৈত্রের অবসানে বর্ষ পরিক্রমায় আবার ঘুরে আসলো বাংলা নববর্ষ। ১৪২৯ শেষে সূচনা হলো ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকেই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি গানে, কবিতায়, নৃত্যে, আলোচনায় নববর্ষকে বরণ করার প্রস্তুতি নেয়। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে নানান ধরণের মুখোশ তৈরী, আলপনা আঁকা, মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার প্রস্তুতি চলতে থাকে আর মনে অনুরণিত হয় ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।’ প্রকৃতিও যেন মেতে উঠে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে। ‘হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুনের খেলা শুরু হয়েছে।’ এ উপলক্ষ্যে মেলা বসে। নানান ধরণের পসরা সাজিয়ে মেলায় নিয়ে আসা হয়। বিক্রেতাদের মধ্যেও প্রাণের স্পন্দন জাগে। আমাদের সময়ে নববর্ষ উদযাপন ভিন্ন ধারার ছিল। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন ৩০ চৈত্র ‘বিষু ফুল এবং নিম পাতা দিয়ে মালা গেঁথে ঘরের দরজা, জানালা এবং পূজার ঘর সাজানো হতো। চৈত্র সংক্রান্তির দিন কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, শস্য একসাথে বেটে গায়ে মেখে স্নান করতে হতো। অনেক রকমের তরকারি দিয়ে পাঁচন রান্না হতো। বছরের প্রথম দিন নতুন জামাকাপড় পরে বড়দের প্রণাম করতাম। দুপুরে ভালো রান্না হতো। তখন শহরে নববর্ষ উদ্যাপন এত ব্যাপ্তি পায় নি। চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রতি বছর মামার বাড়ি নোয়াপাড়া যেতাম। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন বনজ গাছ, ঔষধি লতাপাতা দিয়ে স্তুপ করে আগুন জ্বালানো হতো এবং পরিবারের ছোট বড় সকলে সু্তপের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ধোঁয়া গায়ে লাগাত এ বিশ্বাসে যে ধোঁয়া গায়ে লাগালে খোস পাঁচড়া হবে না, গান করত উচুঁ স্বরে। ‘যাক যাক যাক, মরো বাড়ি যাক (মামার বাড়ি) আঁরো বাড়ির মশা মাছি সাত দইরজা পার হয়ৈ যাক’। গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাড়ু খেতাম, মেলা বসতো (এ মেলা একমাস ব্যাপী চলতো) মেলায় যেতাম, পছন্দের জিনিস কিনতাম।
এ সময় পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠির বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করতাম। সে সব অনেক দিন আগের কথা তবুও মনে হয় ‘যেন সেদিন সকাল।’ জানা যায় বাদশাহ আকবরের সময় বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। প্রথম পর্যায়ে বাংলা বছর শুরু হতো অগ্রহায়ন মাস থেকে। সম্রাট আকবর ফসলি মাস হিসাবে বৈশাখ মাসকে প্রথম ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। সেটা হিজরী ৯৬৩ তম বর্ষ ইংরেজি ১৫৫৬ সন। জমিদারী আমলে পয়লা বৈশাখের প্রধান আয়োজন ছিল খাজনা আদায় উপলক্ষ্যে ‘রাজপূণ্যাহ’ এবং ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’। বর্তমানে জমিদারি প্রথা বিলোপ হওয়ায় কারণে ‘রাজপূণ্যাহ’ আর নেই। তবে ‘হালখাতা’র কথা শোনা যায়। বাংলা নববর্ষ এখন শহুরে সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। অতীতের হিন্দু এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ধর্মভিত্তিক পারিবারিকভাবে নববর্ষ পালন করত। এখন নববর্ষ বিশেষ সম্প্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। শহরে নববর্ষ উদযাপন মূলতঃ ব্যাপ্তি লাভ করে ঢাকায় ১৯৬৫ সন ১৩৭২ বঙ্গাব্দে ‘ছায়ানট’ এর আয়োজনে। রমনার বটমূলে ভোরবেলায় নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার সূচনা হয়। সম্মিলিত ভাবে শিল্পীরা ‘এসো হে, বৈশাখ এসো, এসো’ এ রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে নববর্ষকে বরণ করা হতো। সেই সময় থেকে ধীরে ধীরে নববর্ষ উদযাপন বাঙালির জাতির উৎসবে পরিণত হয়। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক, ছাত্র–ছাত্রীরা বর্ণিল শোভাযাত্রা করে বাংলা বর্ষবরণকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় ২০১৬ তে জাতিসংঘের ইউনেসকো এ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইউনেসকো যথার্থই বলেছেন, এ শোভাযাত্রা ‘অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক।’ চট্টগ্রাম শহরেও একসময় বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংগঠন সীমিত পরিসরে নববর্ষ পালন করতেন। ১৯৮৫/৮৬ থেকে ‘সবার যোগে বাংলা নববর্ষ জয়যুক্ত হোক’ এ শ্লোগান নিয়ে ডিসি হিলে সম্মিলিতভাবে নববর্ষ বরণ এবং পরে বর্ষ বিদায় অনুষ্ঠানও উদ্যাপন শুরু হয়।
এ উপলক্ষ্যে বিশাল এলাকা জুড়ে মেলা বসে। কালক্রমে এ আয়োজন মিলন মেলায় পরিণত হয় সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সাম্প্র্রতিক সময়ে টাইগার পাস এলাকার সিআরবি’র শিরীষ তলায় এবং বাওয়া স্কুলের মাঠেও নববর্ষের উদ্যাপন হয়। শিশুতোষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ফুলকি’ ছোটোদের জন্য মেলার আয়োজন করে বর্ণিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের তৈরি সামগ্রী দিয়ে মেলা সাজায়। শিশুদের বড়দের অংশগ্রহণে এ মেলা নব আনন্দে নব নব রূপে জেগে উঠে। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে নতুন আশায় উদ্ভাসিত হওয়ার বারতা নিয়ে আসে নববর্ষ। পারস্পরিক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে, ঐক্যের ভিত্তিতে অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এ বাংলাদেশকে সামগ্রিক ভাবে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করতে হবে। আমরা যে যে অবস্থানে থাকি না কেন নিজ নিজ দায়িত্ব সততার সাথে পালন করব। স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর হলো– এ সময়ে আমাদের অর্জন কম নয়। কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানিও আছে। একটি দেশের উন্নতি কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন মাত্র নয়। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞান চর্চায়, খেলাধুলায় আমাদের তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।
সাবধান হতে হবে যাতে ইতিহাস নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি না হয়। এ দায়িত্ব আমাদের যারা বয়সে প্রবীণ। পরিশেষে বলি ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।’ আশা করি পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন বাঙালি সংস্কৃতির এ চর্চা আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। আমরা প্রকৃত বাঙালি হয়ে ওঠার তাগিদ অনুভব করব। ১৪৩০ বঙ্গাব্দ সকল কলুষতা দূর করে বয়ে আনুক সকলের জন্য অনাবিল আনন্দ ও স্বস্তিময় জীবন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি চারুকলা কলেজ।