খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এই ধরুন ২৫, ৩০ বছর আগেও ড্রইং রুমে একটা যাদুর বাঙ থাকতো। গৃহিণীরা আর ছেলেপুলেরা কাজকর্ম, লেখাপড়া সেরে বসে পড়তো যাদুর বাঙটির সামনে। পিনপতন নীরবতা নিয়ে সবাই বসে পড়তো কারণ সূচনা সংগীত বাজছে আর শুরু হতে যাচ্ছে ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি‘।
‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’ সংশপ্তক’ এই ধারাবাহিক নাটকগুলোর জন্য সপ্তাহব্যাপী অপেক্ষা করতাম আগ্রহ নিয়ে। আর পরিবারের সবাই একসাথে হাসতাম, কাঁদতাম ও বিনোদন নিতাম নাটকগুলো দেখে। সবার চক্ষু স্থির হয়ে থাকতো টিভি পর্দায়। ভিন্নধর্মী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ‘ইত্যাদি‘ আর বিদেশী একশান নির্ভর ড্রামা সিরিয়াল ‘ম্যাকগাইভার‘ দেখার সময় সে কি উত্তেজনা! বর্তমানে বিনোদন হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর। স্মার্ট টেলিভিশন আর স্মার্ট ফোন দর্শকদের বিনোদনের খোরাক দিচ্ছে। অর্থাৎ দর্শকদের পট পরিবর্তন ঘটেছে। ইউটিউব, ফেইসবুক ও গুগলের মাধ্যমে দেশ–বিদেশের খবরাখবর, নাটক, সিনেমা ও বাহারি প্রোগ্রাম উপভোগ করতে পারছে দর্শকরা। নেট–দুনিয়ায় সব কিছুই এখন তাদের হাতের মুঠোয়। গতানুগতিক ধারার বাইরে তারা। পারিবারিক বন্ধনে টিভি দেখা এখন অতীত প্রায়। বিনোদন এখন একান্ত ব্যক্তিগত। প্রত্যেকে যার যার মত করে মুঠোফোন ও স্মার্ট টিভিতে পছন্দের কনটেন্ট দেখে। একই রুমে শুয়ে, বসে যে যার মতো করে মুঠোফোন, লেপটপ ও স্মার্ট টিভিতে তাদের পছন্দের পোগ্রাম দেখে নিচ্ছে।
বিনোদনের ক্ষেত্রে তথ্য–প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটিয়েছে। শিশুরাও এখন মাঠ ছেড়ে মোবাইলে ও কম্পিউটারে গেইম খেলছে। তবে প্রশ্ন হলো –এই অনলাইন বিনোদন আমাদের গ্রাস করছে না তো? একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। অনলাইন গেইমে আসক্ত হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে অনেকে শিশু। তারা লেখাপড়া, সাহিত্য –সংস্কৃতি চর্চা, সুষ্ঠু আদব কায়দা, সামাজিকতা এইসব থেকে বহু দূরে সরে যাচ্ছে। অধিকাংশ সময় তারা অপচয় করে অনলাইন বিনোদনের নামে অপসংস্কৃতি রপ্ত করে। এই বিনোদন তাদের সময়, অর্থ, মেধা সবই গ্রাস করে নিচ্ছে। অশ্লীল বিনোদনে গা–ভাসিয়েছে শিশু, তরুণ প্রজন্ম এমনকি বয়স্করাও। এই সস্তা বিনোদনের খপ্পরে পড়ে পরকীয়ায় মজেছে অনেকে, ভাঙছে অনেক সংসার। মা–দিদিমা–ঠাকুম্মার কাছে এখন যুবতীরা পিঠা–পুলির রেসিপি, নানা রকম হাতের কাজ ও সূচিকর্ম, সোয়েটার বুনন নকশী কাঁথা সেলাই, পাখা ও পাটি বানানোর মতো হাতের কাজ আর শিখতে চায় না। তাদের সময় কাটে এনড্রোয়েড ফোনে মাথা গুঁজে দিয়ে।
তবে বিনোদন সুস্থ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় রাখার চিন্তা মাথায় রেখে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নির্মাণ করা উচিৎ। অনুষ্ঠান যেন হয় শিক্ষণীয়। নৈতিক শিক্ষা লাভের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে। অপসংস্কৃতি, পর্নোগ্রাফী, সুড়সুড়ি দেয়া টিকটক ইত্যাদি বিনোদন জগতে জায়গা করে নিয়েছে। তরুণ সমাজ আজ এক অশ্লীল সংস্কৃতির সাথে পরিচিত। তারা রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, লালনগীতিতে বিনোদন খুঁজে না। গল্প, উপন্যাস, নাটক ও কবিতা পড়েও বিনোদন নেয় না। মেধাশক্তিহীন কিন্ত প্রযুক্তিনির্ভর ছাত্র–ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষকদের পড়তে হচ্ছে বিপাকে। ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ে তারা একেবারেই দুর্বল কিন্তু অনলাইনের সবকিছু তাদের নখে–দর্পণে। যে পঙ্গু জাতি গড়ে উঠছে আজ, রাষ্ট্রকে তার দায়ভার নিতে হবে ভবিষ্যতে। সরকারের উচিৎ জাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার মতো ওয়েবসাইটগুলি অনতিবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া। অনলাইন গেইম এবং টিকটকের হাত থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করা।