বিভিন্ন গণমাধ্যম–জনশ্রুতি মতে চলমান দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি সৎ–যোগ্য–বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে প্রবল কৌতুহল জাগ্রত করেছে। জনকল্যাণ নিশ্চিতকল্পে জাতিরাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিচালনায় পবিত্র সংবিধান সম্মত স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন–পরিবর্তন সর্বত্রই স্বীকৃত।
ভোটারদের রায়ে দলীয় পরিচয়ে জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন সুস্থ রাজনীতির মৌলিক অনুষঙ্গ। তবে নাম–গোত্রহীন দলের আকস্মিক আত্মপ্রকাশ ও কথিত কর্মসূচির নামে দেশবিরোধী তৎপরতা দেশবাসীকে চরম সংক্ষুব্ধ করে। উন্নত–উন্নয়নশীল–অনুন্নত বিশ্বের যেকোনো দেশে আমাদের মতো এত সংখ্যক রাজনৈতিক দলের অবস্থান আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ–সংশয় রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিভাজিত মতাদর্শের ভিত্তিতে দল গঠন অস্বাভাবিক না হলেও, তার সীমাহীন সংখ্যা নিয়ে দেশে হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আমাদের সকলের জানা, পৃথিবীর অনেক দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের বিপরীতে একদলীয় শাসনব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত। আবার কিছু কিছু দেশে বহুদলীয় নির্বাচন পদ্ধতি থাকলেও দেশের অধিকাংশ জনগণের সমর্থন শুধুমাত্র দুটি দলের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ এবং দুটি দলই বারবার ক্ষমতার পট পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইংল্যান্ডের কনজার্ভেটিভ ও লেবার পার্টি এবং ১৯৪৯ সাল থেকে জার্মানির খ্রিষ্টান ও সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি দুটির অস্তিত্ব বিরাজমান।
যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক ছাড়াও দা লিবার্টিয়ান, কনস্টিটিউশন, সোশালিস্ট অথবা গ্রীনপার্টি নামে ও জার্মানিতে আছে মুক্ত গণতান্ত্রিক দল নামে ছোট রাজনৈতিক দল। লিবারাল–ন্যাশনাল কোয়ালিশন বনাম অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির পরিচয়ে শতবর্ষ প্রাচীন অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতির মাঠে এক ধরনের দ্বি–দলীয় ব্যবস্থার আধিপত্য গড়ে উঠেছে। এছাড়া দ্য গ্রিনস, ওয়ান নামের দলের সন্ধানও রয়েছে।
এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলে জাপানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর মধ্যে প্রধান লিবারেল ডেমোক্রেটিক দল ছাড়াও আছে জাপান সমাজতন্ত্রী ও কম্যুনিস্ট দল। চীনে একাধিক রাজনৈতিক দল বিদ্যমান রয়েছে। ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আরো আটটি গণতান্ত্রিক দল আছে যেগুলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পূর্বেই গঠিত হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির সংগে দীর্ঘদিন সহযোগিতা করা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকে সমর্থনের মধ্যেই এসব দলের কার্যক্রম সীমিত। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল সংবিধানকে তাদের রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের মূলভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে।
তারা রাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন এবং সমান আইনগত অবস্থানও পেয়ে থাকে। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলের সংগে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতার প্রচলিত নীতি হলো দীর্ঘদিন সহাবস্থান, পরস্পরকে তত্ত্বাবধান ও আস্থা–বিশ্বাসের সাথে রাষ্ট্রের সকল সুখ–দুঃখকে সমভাবে ধারণ করা।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের রাজনৈতিক দল যারা স্থানীয়–রাজ্য–জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় তাদের ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হয়। নিবন্ধিত দলগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ডের ভিত্তিতে স্বীকৃত জাতীয় বা রাজ্য স্তরের দল হিসেবে উন্নীত করা হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশনা অনুযায়ী নিবন্ধিত দলের মধ্যে ৮টি জাতীয় ও ৫২টি রাষ্ট্রীয়।
পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য দলগুলোর মধ্যে রয়েছে– পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ), পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ইমরান খান নেতৃত্বাধীন তেহরিক–ই–ইনসাফ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (ফজল), পশতুনখোয়া মিল্লি আওয়ামী পার্টি, ন্যাশনাল পার্টি (বিজেঞ্জা), বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টি (মেনসাল), আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি, কওমি ওয়াতন ও জমিয়তে আহলে হাদিস। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলের মধ্যে আছে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি, মুসলিম কংগ্রেস, আজিজ ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স কংগ্রেস, ইলঙ্কাই তামিল আরাসু কাচ্চি ও জনতা বিমুক্তি পেরুমানা ইত্যাদি।
৩০ অক্টোবর ২০২২ বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে বর্তমানে দেশে মোট নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৮টি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আবেদনের প্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত ৮০টি দল নতুন করে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। মূলত ২০০৮ সাল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে কমিশনের নিবন্ধ বাধ্যবাধকতা থাকায় ঐ সময় ১২৬টি দলের আবেদনের বিপরীতে ৩৯টি দল নিবন্ধন পায় যার মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো।
পর্যায়ক্রমে আরও কিছু নতুন দল সৃষ্টি হয়ে ২০১৩ সালে ৪৩টি দল আবেদন করলে মাত্র ৩টি দল নিবন্ধন পায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়কালে ৭৬টি দল আবেদন করলেও ন্যূনতম শর্ত পূরণ না হওয়ায় কোনো দলকেই নিবন্ধন দেয়া হয়নি। যদিও নির্বাচনের পর উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে ২টি দল নিবন্ধিত হয়। অতএব বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা থাকার কথা ৪৪টি। কিন্তু বাস্তবে বেশ ক’টি দল নিবন্ধের শর্ত প্রতিপালন না করায় তাদের নিবন্ধ বাতিল হয়েছে।
দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, বিগত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের দুই বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জোটের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে নিয়ে নতুনভাবে জোট সাজানোর প্রক্রিয়া অতিশয় দৃশ্যমান। ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, এবারও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের জোটে একের পর এক দল যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু অনিবন্ধিত–শূন্য জনসমর্থন দলের নামে নামসর্বস্ব কার্যকলাপ কতটুকু গ্রহণযোগ্য তার সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
দলীয় প্রধান ছাড়া নেতা–কর্মী ও দলীয় কার্যালয়–নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন–সাংগঠনিক কমিটি বিহীন দল গঠনের ঘোষণা কখনোই সুষ্ঠু রাজনীতিকে বিকশিত করে না। বিজ্ঞজনের মতে, এখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নীতি–আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে শুধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করছে। নীতি–আদর্শ থাকলে দেশের রাজনীতির এমন দুরাবস্থা হতো না। ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে এরকম অনভিপ্রেত দল–জোটের সৃষ্টি কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।
গণমাধ্যম সূত্রানুযায়ী অতিসম্প্রতি বিরোধী দলের নেতৃত্বে তথাকথিত সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে গঠিত ৫৪ দলের জোট নিয়েও আছে নানা মুখরোচক মন্তব্য। সমসূত্র অনুসারে, এই ৫৪ দলের মধ্যে সংগঠনের শীর্ষ নেতা হিসেবে আছেন পল্টন মোড়ের মোজা বিক্রেতাসহ আদম কারবারিও।
কর্মসূচিতে ব্যানার ধরার মতো কর্মী নেই এমন দলও নেহায়েত কম নয়। বিরোধী দলের জোটবদ্ধ আন্দোলনে রয়েছে সাতদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, চার দলের বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য, ১৫ সংগঠনের সমমনা গণতান্ত্রিক জোটসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এসব জোট–দলের মধ্যে মাত্র সাতটি ইসি নিবন্ধিত। আবার ১৩টি বিভিন্ন দলের খন্ডিত অংশ এবং ১৫ সংগঠন বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় প্রেস ক্লাবকেন্দ্রীক আলোচনা সভা–মানববন্ধনের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
বিভিন্ন গণ কর্মসূচি পালনে এসব জোটের নেতাকর্মীর উপস্থিতিও ছিল হতাশাব্যাঞ্জক। খোদ বিরোধী দলসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা এসব জোটের সত্তা–বিদ্যমানতা নিয়ে ঠাট্টা–বিদ্রুপ–অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে জোটের ভেতর সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ–অবিশ্বাস আর দুরত্ব।
জোট–দল গঠনের দোলাচলে জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার নামে বিরোধী দল ২৭ দফা সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেছে। তাদের দাবি একটি অবাধ–সুষ্ঠু–গ্রহণযোগ্য–অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
এটিকে তারা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের দফা হিসেবে নয়; বরং আন্দোলন সফল হওয়ার পর গঠন হওয়া সরকারের জন্য রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামতের রাজনৈতিক কর্মসূচি বলে প্রচার করে আসছে। ইতিমধ্যে অনেকেই এই রূপরেখাকে ‘কথার ফুলঝুরি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ভালো ভালো কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন না করা এবং বিশ্বাসভঙ্গের নজির প্রবল। তাই রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতিতে মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এই রূপরেখায় কোথায় কোথায় মেরামত বা সংস্কার দরকার বা ক্ষমতায় গেলে কোন কোন জায়গায় সংস্কার করা হবে সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট তালিকা দেওয়া হয়নি। উপরন্তু ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে নেওয়া ‘রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কার’ স্লোগান দেশ–জনগণের কল্যাণে কতটুকু অবদান রাখবে তা ভেবে দেখার বিষয়।
এটি অনস্বীকার্য যে, সাধারণ মানুষ জীবনযাপনের তাগিদে প্রতিনিয়ত যেসব পরিস্থিতি ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানে তাদেরকে যেতে হয় এবং অধিকাংশক্ষেত্রে তাদেরকে হয়রানির শিকার হতে হয় সেসব ক্ষেত্রে সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। তবে ‘রাষ্ট্র’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করে তার সাথে ‘মেরামত’ সংযুক্ত করার বিষয়টি কতটুকু সংবিধান সম্মত–আইন সিদ্ধ–বিবেকপ্রসূত তাও বিবেচ্য।
বিগত সেনা–স্বৈর শাসনকালে রাষ্ট্র কাঠামো থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে যার যার সুবিধা মাফিক পরিবর্তন–পরিমার্জন–পরিবর্ধন করে দেশ–সরকার–জনগণের যে ক্ষতি সাধন করা হয়েছে তার যৌক্তিক সংশোধন বর্তমান সরকারের আমলে বেশ জোরালোভাবে পরিলক্ষিত। আমাদের পবিত্রতম রাষ্ট্র নয় বরং ব্যক্তি–দলীয় চরিত্রের আদর্শগত–দেশপ্রেমে উজ্জীবিত–মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকল কিছুর মেরামত অবশ্যম্ভাবী।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়