প্রমীলা গোয়েন্দা

শাহনাজ খান | শনিবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ

অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষের শুভ মহরৎ সিনেমার পিসি (রাখী গুলজার) চরিত্রের কথা মনে আছে? ২০০৩ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত সিনেমা “শুভ মহরৎ”। আগাথা ক্রিস্টিও ‘mirror cracking from side to sid’ কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্রায়িত। বাঙালি সেকেলে বিধবা এক গৃহবধূ ব্যোমকেশ বা ফেলুদার মতো ঘরে বসে কেস স্টাডি করে রহস্যের উন্মোচনও করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

যদিও গোয়েন্দা বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠোঁটে পাইপ, মাথায় টুপি, গায়ে ওভারকোট এবং খাড়া নাকওয়ালা একজনের অবয়ব। এক কথায় একজন শার্লক হোমস! গোয়েন্দা বলতে পুরুষ গোয়েন্দাদেরই আমরা কমবেশি সকলে চিনি, সে গল্পেরই হোক কিংবা বাস্তবে। এক্ষেত্রে আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পল বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কিন্তু বাস্তবে নারী গোয়েন্দাদের অস্তিত্ব কোথায়?

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, সালটা ১৮৫৬। অ্যালান পিংকারটন নামে এক ভদ্রলোক শহরে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসেছেন। এজেন্সির নামও বেশ চমকপ্রদ ‘পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি’। এজেন্সির জন্য কয়েকজন পেশাদার গোয়েন্দা এবং একজন মহিলা সেক্রেটারি চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন অ্যালান। অনেকেই এসে ইন্টারভিউ দিয়ে গিয়েছেন।

একদিন হঠাৎ পিংকারটনের অফিসে এসে হাজির ২২২৩ বছরের এক তরুণী। অ্যালান তাকে দেখে ভেবেছিলেন মেয়েটি সেক্রেটারির পদের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। কিন্তু সে জানায়, সে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতে চায়। অ্যালান তাকে বোঝাতে চাইলেন গোয়েন্দাগিরি নারীদের পেশা নয়। এতে রয়েছে পদেপদে বিপত্তি, প্রাণের ঝুঁকি, সম্ভ্রম হারানোর ভয়। মেয়েটি তাতে মোটেই দমবার পাত্রী নয়। সে নাছোড়বান্দা। তার যুক্তি, মেয়ে হলে গোয়েন্দাগিরি নাকি ঢের সোজা হয়ে যায়।

অপরাধীদের গিন্নি অথবা বান্ধবীদের সঙ্গে একবার ভাব জমিয়ে নিতে পারলেই ভেতরের গোপন কথা এক নিমেষে বের করে আনা যায়। মেয়েটির নানা যুক্তিতর্কে অ্যালান শেষমেশ মেয়েটিকে গোয়েন্দা পদে নিয়োগ দিতে সম্মতি দেন। এহল ইতিহাসের সত্যিকারের প্রথম পেশাদার গোয়েন্দার উদ্ভাসের কাহিনী।

বিশ্বজুড়ে অপরাধীদের ধরতে কিংবা অন্যদেশের গোপন তথ্য হাতিয়ে নিয়ে বহু যুগ আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছেন নারী গোয়েন্দারা। দুর্র্ধর্ষ সেসব গোয়েন্দাদের মারাত্মক সব অভিযানের কথা হয়তো জানি না অনেকেই। আসল পরিচয় গোপন করে তথ্য সংগ্রহই তাদের নেশা ও পেশা। প্রতি পদে পদে রয়েছে জীবননাশের ঝুঁকি, তবু থেমে নেই তাদের কর্মকাণ্ড। মাটা হ্যারি, নুর ইয়ানাত খান, এডিথ শাভেল, জোসেফাইন ব্যাকার, ক্রিস্টিনা স্টারব্যাক, আন্না চ্যাপম্যান এরা সবাই কিন্তু সত্যিকারের দুনিয়াকাঁপানো গোয়েন্দা।

ইংরেজির মতন বাংলা সাহিত্যেও পুরুষ গোয়েন্দাদের জয়জয়কার। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কীরিটি প্রমুখের কথা প্রায় সকলেই জানেন। মজার ব্যাপার হল, মিতিনমাসী, গোয়েন্দা গিন্নিদের বহুযুগ আগেই গোয়েন্দা শিখা, গোয়েন্দা কৃষ্ণারা নানা রহস্যকাণ্ডের কিনারা করায় ছিলেন অদ্বিতীয়া। যাদের স্রষ্টা ছিলেন লেখিকা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী (First Woman Writer Prabhabati Debi Saraswati)। প্রভাবতী দেবী নিজের জীবনেও বহু শেকল ভেঙে নিঃশব্দ নারী বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।

পল্লীসখা’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে প্রভাবতী দেবী (Prabhabati Debi) লিখেছেন “মেয়েদের শাসন আমাদের দেশে বড়ই কড়া। তাহাদের অতি শিশুকাল হইতেই কঠোর শাসনের তলে থাকিতে হয়। যেসময়টা বিকাশের, সেসময়টা তাহাকে বন্ধ করিয়া রাখা হয়। অন্য দেশে যে সময়টা বালিকাকাল বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে, আমাদের দেশের মেয়েরা সেই সময়ে গৃহের বধূ, অনেক সময়ে সন্তানের মা।”

ঠিক একই ঘটনা ঘটে প্রভাবতীর নিজের জীবনেও। কিন্তু যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যেতে যেতেও নিজের মনের জোরে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। তাই আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো তাঁর জীবন চলেনি, রাশ রেখেছেন নিজের হাতে, বেঁচেছেন নিজের শর্তে (First Woman Writer)। যার জীবনকাহিনি, রচিত কাহিনি আদর্শ হতে পারত মেয়েদের অথচ হঠাৎই তিনি যেন বাংলা সাহিত্যে লুপ্তপ্রায় হয়ে গেলেন। এই সময়ের প্রকাশকদের কাছে তিনি যেন বাতিল হয়ে গেলেন।

চারিদিকে শুধু সবুজ, কোথাও ঘাসে ঘেরা, কোথাও আবার মাথা পর্যন্ত উঁচু গাছ। তার মধ্যে দিয়েই ঝড়ের গতিতে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলেছে এক তরুণী। নাম ইনোলা হোমস (মিলি ববি ব্রাউন)। ইংরেজি অক্ষরে পিছন থেকে পড়লে তার নাম দাঁড়ায় ‘অ্যালোন’ অর্থাৎ একা।

ছোটবেলা থেকে একা একাই কেটেছে তার, মায়ের (হেলেনা বনহ্যাম কার্টার) সঙ্গে। ইনোলার দুই ভাই শার্লক হোমস (হেনরি কেভিল) এবং মাইক্রফট হোমস, দু’জনেই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ছোট ইনোলার জন্য তাঁদের সময়ই বা কোথায়? কিন্তু হঠাৎ ইনোলার মা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় দুই ভাই ছুটে আসে বাড়িতে। ইনোলার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

মাকে খুঁজে পেতে ইংল্যান্ডের ব্যস্ততম শহর লন্ডনে পাড়ি দেয় সে। ঘটনাচক্রে, তার পরিচয় হয় লর্ড টুইক্সবরির (লুই পার্ট্রিজ) সঙ্গে। লর্ড টুইক্সবরিকে কে খুন করতে চায়, সেই রহস্যের সমাধান ইনোলা করলেও তার নাম, যশ জুটেছিল শার্লকের ঝুলিতে। বর্তমান সময়ে যে নারী গোয়েন্দা চরিত্রের সিনেমা সবচাইতে সাড়া ফেলেছে, তা হল ইনোলা হোমস্‌।

দু’বছর আগে ইনোলা হোমসের সঙ্গে দর্শকের পরিচয় হয় এ ভাবেই। ২০২০ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ‘ইনোলা হোমস’ ছবির প্রথম পর্বে ইনোলা এবং শার্লক হোমসের যুগলবন্দি সকলের মন জয় করেছিল। আবার কবে হোমস পরিবারকে পর্দায় দেখতে পাওয়া যাবে, সেই অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন দর্শক। সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। এই ছবির দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে নেটফ্লিক্সে হাজির হলেন পরিচালক হ্যারি ব্র্যাডবিয়ার। তবে, দ্বিতীয় পর্বে নয়া রূপে আসে ইনোলা। আর্থার ক্যানান ডয়েলের বইতে কোথাও শার্লকের কোন বোনের কথা উল্লেখ নেই, এই কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ন্যান্সি স্প্রিঙ্গার।

বিশ্বে এখন নারী রহস্যরোমাঞ্চ লেখকের সংখ্যা বহু, আর তাঁদের অনেকেই সহজাতভাবে সৃষ্টি করে যাচ্ছেন নারী গোয়েন্দা চরিত্র। নিউইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় চোখ বোলালেই এর দেখা যায় এই নারী গোয়েন্দাদের জনপ্রিয়তা প্রচুর। তবে বাংলা ভাষায় নারী গোয়েন্দার সংখ্যা হতাশাজনকভাবেই কম।

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি এবং তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা গার্গী ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো নারী গোয়েন্দার দেখা পাওয়া ভার। এর কারণ সম্ভবত গোয়েন্দা কাহিনি কিংবা জনরা ফিকশন এখানে শুরু থেকেই অনিয়মিতভাবে লেখা হয়েছে, আর যেগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো পশ্চিমা লেখকদের গল্প অনুকরণে, নয়তো হুবহু।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যক্তি-দলীয় চরিত্রের মেরামতই কাম্য
পরবর্তী নিবন্ধআমরা কবে মানুষ হব!