আমরা কবে মানুষ হব!

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ

দু’হাজার বিশের ষোল মার্চ ঘরে ফেরার সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হলে সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় কেবলই মনে হতে লাগলআর কি হবে দেখা! আবার কি আসব ফিরে এই প্রাণের কর্মস্থলে! তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে কপাট লাগাই। আকাশ দেখতে ছাদে যেতেও ভয় পাই। পনের তারিখ বিকেলেও ছেলেমেয়েরা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলছিল। ষোল তারিখ সব সুনসান; ঠিক যেন ভূতের শহর, কিংবা ভৌতিক ছায়াছবির চিত্রনাট্য রচিত হচ্ছে সর্বত্র। কোভিড১৯ দুহাজার বিশ, একুশ বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়িয়ে বাইশে এসে কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছে। চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, আবার জেগেও উঠতে পারে। সময়ই তা বলে দেবে।

খবরে প্রকাশ, চীনদেশে আবারও হানা দিয়েছে করোনা নামের অণুজীব। যদিও আমরা নির্বিকার ছুটে চলেছি অজানার পথে।

টানা ঘরে থাকার দিনগুলোতে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পুরে রেখেছিলাম আমরা। শুভানুধ্যায়ীগণ প্রতিদিনই কোন না কোন তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্র, গান, কবিতা কিংবা স্মরণীয় বাণী পাঠাতেন অন্তর্জালে।

মূলবার্তা অনেকটা একইঅতিমারি থেকে আমরা শিক্ষা নেব, বদলে যাবে মানবজাতি, মানবতা জেগে উঠবে পৃথিবীর বুকে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে আমরা ঘাট মেনেছিলাম যে আমাদেরই ভুলে ‘মাতা বসুমতি’ রুষ্ট হয়েছেন এবং সন্তানদের শুদ্ধিকরণের জন্যই পরীক্ষা নিচ্ছেন। এই পরীক্ষায় পাস করতে হলে আমাদের মানুষ হয়ে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বৈষম্য, হিংসাপ্রতিহিংসা, প্রতিক্রিয়াশীলতাসহ যাবতীয় অপশক্তিকে পৃথিবী থেকে তাড়াতে হবে। পরীক্ষা চলাকালীন দুঃসহ প্রহরে অর্ধকোটি প্রাণ হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। বিত্তের অর্থহীনতা প্রত্যক্ষ করে বিশ্বসম্প্রদায়।

আমরা বেঁচে যাওয়া মানবসম্প্রদায় ভুলেই গিয়েছি মৃত্যুর মিছিলে আমাদেরও থাকার কথা ছিল। আমারতো প্রাণভরে খোলা আকাশের নিচে গিয়ে শ্বাস নেওয়ার কথা ছিলনা, প্রাণের মানুষদের সঙ্গে আবারও কর্মযজ্ঞে মেতে ওঠার কথা ছিল না, বৈশাখের আগুনঢালা দুপুরে সোনালু, জারুলের ছায়ায় প্রাণ জুড়ানোরও কথা ছিল না। আলোর পাখিদের সামনে বসিয়ে ইতিহাসের অলিতেগলিতে ভ্রমণ করে বেড়াবঘরবন্দি থাকার দিনগুলোতে সেই স্বপ্ন দেখার সাহসও ছিল না। অথচ কত দ্রুত আমরা সব ভুলে গিয়েছি।

আবার ব্যস্ত নাগরিক সূচিতে ফিরে গিয়েছে নগরবাসী। মৃত্যুভয় কাটিয়ে মেতেছে নতুন প্রাণের উৎসবে। কিন্তু উৎসবের ঘনঘটায় প্রাণের ছোঁয়া নয়, বরং বিভেদের ছড়াছড়ি সতত দৃশ্যমান।

কোভিড শিখিয়েছিল বাঁচতে হলে সবাইকে এক হতে হবে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে অসহায়ের দিকে। দু’দণ্ড সময় লাগেনি আমাদের সে শিক্ষাকে শিকেয় তুলে রাখতে। আমরা আবারও মেতে উঠেছি ‘আমরা’ ‘তারা’ র জগত নিয়ে। ‘আমরা’ ‘তারা’র আছে আবার শতশত শাখাপ্রশাখা, যেখানে নীতিআদর্শ নয়, বরং স্বার্থই কথা বলে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিঁড়িতে ভর দিয়ে ওপরে ওঠার মোহে আছন্ন মানবজাতি। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছেও মন ভরে না আমাদের।

প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা হওয়ার বাসনায় বুঁদ হয়ে থাকি। সৃষ্টিতে কোন অবদান রাখতে না পারলেও ধ্বংসে আমাদের জুড়ি নেই। অতঃপর আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পৃথিবী; অস্ত্রের ঝনঝনানি, আর রক্ত ঝরানোর মহোৎসবে মেতে ওঠে মানবজাতি। শ্রেষ্ঠত্বের কোন দাবি কি করতে পারে এই ‘মানবজাতি’? সভ্যতারই বা কি গৌরব ধারণ করে এই মানবসভ্যতা?

বৈষম্য আর বিভেদ বাঁচিয়ে রাখায় নিখিল বিশ্বের তুলনায় আমরা বাঙালিরা এক কাঠি সরেস বললে ভুল বলা হয় না। রাজনীতির অঙ্গন ছাড়িয়ে শিল্পাঙ্গন, ক্রীড়াঙ্গন, এমনকি শিক্ষাঙ্গনেও বৈষম্য আর বিভেদের নগ্ন মহড়া চলে বছর জুড়ে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো করে রয়েছে জটের সমারোহ। সড়কে যানজটের কথা নাই বা বলি; এ যে আমাদের চিরসঙ্গী।

শিক্ষায় জট, চিকিৎসায় জট, ব্যবসায় জটজীবনের প্রতি পদে জট আর জট। তবে নির্বাচনে কোন জট নেই। বাঁচি কি মরি, নির্বাচন সংঘটিত হয়ে যায় পালা করে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে সুসজ্জিত মঞ্চে অভিবাদন গ্রহণ করেই মেয়াদ শেষ করে দেন। সমাজ জীবনে বড় ধরনের কোন ইতিবাচক পরিবর্তন চোখে পড়ে না। জনতা তবু তাঁদের সাফল্যের জয়গান গেয়ে যায়, তাঁদের নামে জয়োধ্বনি করে যায়।

নির্বাচনে কোন কিছু বদালায় না জেনেও নির্বাচিত হওয়ার জন্য এমন করে মরিয়া হয় না কোন জাতির মানুষ। কে জানে হয়তো নির্বাচিতদের ভাগ্য বদলে যায়; কারও কপাল খোলে, আবার কারওবা কপাল পোড়ে। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন উপনির্বাচনতো থাকেই বছর জুড়ে। তার ওপর শিক্ষা, চিকিৎসা, ক্রীড়া, এমনকি বিনোদন জগতেও নির্বাচনের গরম হাওয়া বয়ে যায়। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বুঁদ হয়ে থাকে নির্বাচনী প্রচার, নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনায়।

সহিংসতাই প্রত্যাশিত। রক্তপাত, প্রাণহানি, নিদেনপক্ষে মানহানি ছাড়া নির্বাচন প্রাণহীন মনে হয়। ভোটের গল্প করে অনায়াসে বছর কাটিয়ে দিতে পারি আমরা। এই ভোট বলে দেয় আমরা একই রঙের মানুষেরা কতখানি দ্বিধাবিভক্ত, প্রতিহিংসাপরায়ণ। অন্য রঙের বা ভিন্ন চেতনার কারও সঙ্গে চোখ বুজে বন্ধুত্ব করে ফেলতে পারি, যদিও এই বন্ধুত্বকে নাটকের অঙ্ক বলে সবাই জানে। কমবেশী অভিনয় সবাইই করতে জানি। এখানে ন্যায় ও সত্য খুঁজতে যাওয়া অবান্তর।

রাজনৈতিক বিভেদ ছাড়া আমাদের মাঝে বড় প্রকট অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভেদ। ধর্মীয় বিভেদ নিয়তই দৃশ্যমান যদিও ধর্ম সেখানে ব্যবহৃত হয় নিতান্তই হাতিয়ার হিসেবে। জন্মলগ্ন হতেই দুই ধারায় বিভক্ত জাতি। দুই ধারা থেকে উৎপত্তি হয়েছে শত শত উপধারার। পরিতাপের বিষয়আমরা চাই না এই বিভেদের অবসান হোক। বরং বিভেদ বাঁচিয়ে রাখতেই মরিয়া।

বিভেদ বিচ্ছিন্নতাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, ক্ষয়ক্ষতি, রক্তপাত, প্রাণহানিতে কেউনা কেউ উপকৃত হয়, ঠিক যেমন করে ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রে ফুলেফেঁপে উঠছে অস্ত্রব্যবসায়ীরা। যে অর্থ দিয়ে কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচানো যায়, নতুন নতুন নগর নির্মাণ করা যায়, সেই অর্থই ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষ মারতে, নগর পোড়াতে।

কাকে অভিযুক্ত করব আমরা? আমরা সবাইই কি কোন না কোনভাবে এই অপকর্মের অংশীদার নই? তবুও আমরা নিজেদের মানুষ বলব? চতুষ্পদ প্রাণীদের কেউতো আমাদের মতো করে স্বজাতির প্রাণ কেড়ে নেয় না, জাতভাই বোনদের হত্যা করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, মেধা খরচ করে নীলনকশা অংকন করে না। কেন আমরা মানবের নিষ্ঠুরতায় ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের পশুর সঙ্গে তুলনা করি? তারা আমাদের চেয়ে উত্তম অনেকাংশে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রমীলা গোয়েন্দা
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে শীতার্তদের মাঝে এলিটের কম্বল বিতরণ