গোল্ড ডিগার: কেবলই নারীর অপবাদ!

ফাতেমা নূর | শনিবার , ১২ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ

পশ্চিমা বিশ্বে অহরহই শোনা যায় এই শব্দটি, আজকাল আমাদের দেশেও এই শব্দটি ব্যবহারের চল হয়েছে, ‘গোল্ড ডিগার’। অন্তর্জালের মুঠোয় বন্দি অত্যাধুনিক এই জগতে শব্দটি কমবেশি সকলেই শুনেছেন। ইন্টারনেটে কয়েকদিন পর পর এমন খবর বেরোয় যে অমুক ধনকুবেরকে ফাঁসিয়েছেন তমুক, অমুক তার প্রেমিক বা প্রেমিকার ধোঁকাবাজির গল্প ফাঁস করছে ইত্যাদি। তো সরল বাংলায় গোল্ড ডিগার শব্দের অর্থ স্বর্ণখনক, স্বর্ণসন্ধানী হলেও সোসাইটিতে এর ব্যবহারিক মানে হচ্ছে; গোল্ড ডিগার এমন একজন নারী যিনি সম্পদ ও টাকা পয়সা লোভে পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন বা যে-নারী শুধুমাত্র টাকা বা উপহারের জন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক করে অথবা ধনী ব্যক্তিদের সাথে অর্থের জন্য সম্পর্ক স্থাপনকারী নারী ইত্যাদি। খেয়াল করে দেখবেন, যে-সকল পুরুষ শুধুমাত্র নারীর সৌন্দর্য, দারুণ দেহসৌষ্ঠব, টাকা, ধন-সম্পদ, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি দেখে বিয়ে করেন তাদেরকে কিন্তু গোল্ড ডিগার বলা হচ্ছে না! কেবল কোনো নারী যদি কঠিন-বাস্তব-অমানবিক পৃথিবীতে ভালভাবে বেঁচে থাকার নিমিত্তে কোনো অসুন্দর বা বয়স্ক পুরুষকেও যদি বিয়ে করেন তখন তাকে আমরা গোল্ড ডিগার বলে টিপ্পনি কাটি। অথচ নারী এবং পুরুষ উভয়ই আলাদা আলাদা দুইটি ক্ষেত্রে গোল্ড ডিগার। ‘গোল্ড ডিগার’ মানে এমন কেউ, যার একটি সম্পর্ক কেবল অর্থ-বিত্তের ভিত্তিতে চলমান। আরেকটু সহজ করে বললে, একটি প্রণয়ের সম্পর্কে থেকে সঙ্গীর কাছ থেকে কেবল টাকা-পয়সা পাওয়র জন্য সম্পর্কটা সচল রাখা। ‘গোল্ড ডিগার’ শব্দটা একটা উভলিঙ্গবাচক শব্দ হলেও লোকে একে কেবল নারীবাচক শব্দ হিসেবেই দেখে এবং ব্যবহার করে। এই শব্দটা বললেই যেন চোখে ভেসে উঠে একজন লোভী-স্বার্থান্বেষী নারীর ছবি।

চলুন একটু ভাবতে চেষ্টা করি একজন নারীকে এই গোল্ড ডিগার তকমা দেওয়ার প্রকরণটি কীভাবে চালু হলো। সাধারণ মানুষ হয়তো মন্তব্য করতে বা কাউকে দোষারোপ করার সময় তেমন কিছু ভাবে না। তারা চট করে সিদ্ধান্ত নেন সাদা চোখে দোষ করেছে মানে দোষী। অপরাধ করেছে তাই অপরাধী। কিন্তু এই সমাজে অপরাধীরা অপরাধী কেন হয়ে ওঠে সেটা নিয়ে ভাবার অবকাশ কারোর থাকে না। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষই সকল আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সমাজ সৃষ্টির আদিকাল থেকে। এখন উপার্জনশীল ব্যক্তিটি যদি হয় পুরুষ মানুষ, তাহলে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই একজন নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্বও যেন পুরুষেরই। তার মানে সমাজ এমন একটি ব্যবস্থা চালু করেছে এবং চালু রেখেছে যেখানে নারী তার সকল আবদার ও চাওয়া-পাওয়া পুরুষের কাছ থেকেই গ্রহণ করবে। ফলে পুরুষ মানুষই সকল আয়ের উৎস এই ধারণা সমাজ বহাল করে রাখার জন্য গোল্ড ডিগার উৎপাদন হয় এবং তা একপাক্ষিকভাবে (বা অবধারিতভাবে) নারীর দিকে আঙুল তোলে।
প্রশ্ন আসে, গোল্ড ডিগার কি শুধু নারীরাই হয়? মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়েই তো অর্থের কাঙাল! দিনরাত যে-পুরুষটি কাজ করে চলেছে, সে কি স্বপ্ন দেখেনা একদিন সে অনেক বিত্তশালী হবে? একইভাবে একজন নারীও তা ভাবতে পারে। তবে তার মানে মোটেও এই নয় যে নারীটিকে সেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা পুরুষের আয়ের উপর নিজের ভাগ বসানোর চিন্তা করতে হবে। প্রতিটি মানুষকেই নিজেকে বিকাশ করার কথা ভাবতে হবে। কিন্তু আমাদের আশেপাশে এমন কিছু নারীর দেখা পাবেন যারা মনে করেন জীবনে উপার্জনের জন্য কায়িকশ্রম বা কোনও কাজ না করলেও চলবে। মওকা বুঝে কোনও এক বিত্তশালীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়লেই জীবন আনন্দে কেটে যাবে। আবার পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে পুরুষের হয়তো এরকম ভাবার সুযোগ নাই, উপার্জন তাকেই করতে হবে। ফলে সে নিজেই নিজের অর্থের জোগানের খোঁজে নামে এবং অর্থের সম্ভাবনা যেখানে আছে সে সেদিকেই ধাবিত হয়। তাই সবাই যেহেতু অর্থ উপার্জনের দিকে ছোটে তাহলে নিশ্চয় কেবল নারীকেই গোল্ড ডিগার বলা যায় না। গোল্ড ডিগার নারী-পুরুষ উভয়েই। সবাই-ই মাটি খুড়ে স্বর্ণ উত্তোলনের অভিপ্রায়ে থাকে।
সামপ্রতিক সময়ে, সুযোগ পেলেই নারীকে অবমাননা করার হার বেড়েছে এবং এই সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চায় না। আলোচনার খাতিরেই বলি, নারী যখন পরকীয়া সম্পর্কে থাকে তখন সেই নারী একা সেই সম্পর্কে যুক্ত থাকে না, যুক্ত থাকে একজন পুরুষও। অথচ সমস্ত কটূকথা বলা হয় নারীকেই। একইভাবে একজন পুরুষের একাধিক প্রেমিকা থাকার বিষয়টিও তো নতুন নয়। কিন্তু পরকীয়া আর একাধিক প্রেম, এই কাজটির ক্ষেত্রে তো নারী-পুরুষের জন্য আলাদা করে বিবেচনা করার কিছু নেই। যে হীন কাজ করবে, সে একজন মানুষ হিসেবেও মন্দ মানুষ, এবং তা নারী কিংবা পুরুষ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে।
তাই কোনো কিছু নিয়ে কটূক্তি করার আগে আমাদের নিজেকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। কাউকে নিয়ে মন্তব্য করার আগে পুরো বিষয়কে পর্যালোচনা কর প্রয়োজন। তা না হলে কখনোই কোনো বিষয়ের সুবিচার ও সমাধান করা সম্ভব হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুধাকণ্ঠ প্রেম
পরবর্তী নিবন্ধফিল্ড হাসপাতাল ফাউন্ডেশনের ফ্রি হেলথ ক্যাম্প সম্পন্ন