সরকারি ওষুধ চুরিতে বড়ধরনের শাস্তির বিধান

নতুন আইন নিয়ে খুশি চমেক হাসপাতাল পরিচালক সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ১২ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

কিছু দিন পরপরই সরকারি ওষুধ চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহের জন্য সরকারি ভাবে এসব ওষুধ দেয়া হয়। কিন্তু গরীব রোগীদের বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও হাসপাতাল থেকে এসব ওষুধ পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বাইরে। আর এই পাচার চক্রে জড়িত খোদ হাসপাতালের কর্মচারীরাই। ফলে হাসপাতাল থেকে সরকারি ওষুধ চুরি যেন কোন ভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। গত ৫/৬ মাসে ওষুধ চোর চক্রের অন্তত ৪/৫ জনকে আটকের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। মামলাও হয়েছে। এরপরও সরকারি ওষুধ চুরি যেন থামছে না। সরকারি ওষুধ চুরির অপরাধে (বিদ্যমান) কম শাস্তির বিধানই এর কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া ওষুধ চুরির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা কদিন পরই জামিনে বের হয়ে আসেন। আইনে কঠোরতা না থাকায় অসাধু চক্র এমন অপকর্ম করতে সাহস পায়। তবে নতুন ওষুধ আইন সরকারি ওষুধ চুরি ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।
লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ আমদানি, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রি, সরকারি ওষুধ চুরির মত অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি জরিমানার বিধান রেখে নতুন আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল (১১ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ওষুধ আইন, ২০২২’ এর খসড়ার নীতিগত এ অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম আইনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এটা ‘অনেক বড় আইন’; মোট ১০৩টি ধারা এ আইনে রাখা হয়েছে। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সরকারি ওষুধ, ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ওষুধগুলো কোনোভাবেই যেন ট্রানজেকশনের মধ্যে না আসে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো ওষুধ আমদানি করা যাবে না।
এ আইন ভাঙলে ‘ব্যাপক’ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, লাইসেন্স ছাড়া কেউ ওষুধ আমদানি করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এ আইনে এটাই সর্বোচ্চ শাস্তি। নিবন্ধন ছাড়া কেউ ওষুধ উৎপাদন করলে, উৎপাদন করে আমদানি-রপ্তানি, বিক্রি, বিতরণ, মজুদ অথবা প্রদর্শন করলেও ১০ বছরের জেল এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা হবে। ভেজাল ওষুধ তৈরি, বিক্রি, মজুদ করলেও একই মাত্রায় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। তাছাড়া সরকারি ওষুধ চুরি করে যদি কেউ বিক্রি করে, তাহলেও ১০ বছরের জেল এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। অর্থাৎ সরকারি ওষুধ চুরির অপরাধে বড় ধরণের শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে নতুন আইনে। মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন পাওয়ায় খসড়া আইনটি পাসের জন্য পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। আর জাতীয় সংসদে পাসের পরই আইনটি কার্যকর হবে। সরকারি ওষুধ চুরি ঠেকাতে এ ধরনের কঠোর আইনই প্রয়োজন বলে অভিমত চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। নতুন এ আইন কার্যকর হলে ওষুধ চুরিতে জড়িত অসাধু চক্র ভয়ে থাকবে। কারণ, একবার ধরা পড়লে দশ বছরের জেল আর সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা জরিমানা, এই শাস্তির কথা জানতে পারলে তারা আর এ অপকর্ম করতে সাহস পাবে বলে মনে হয় না। সরকারি ওষুধ চুরির মতো অপকর্ম ঠেকাতে এমন কঠোর আইনই প্রয়োজন। আমরা চাইবো যত দ্রুত সম্ভব এ আইন কার্যকর হোক।
প্রসঙ্গত, গত ৭ ফেব্রুয়ারি সরকারি বিনামূল্যের ওষুধ বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে দুজনকে আটক করে হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। এদের একজন হাসপাতালের সরকারি কর্মচারী আশু চক্রবর্তী (৩২)। তিনি ২৬ নং ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ছিলেন। অপরজন আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারী মো. সৈয়দ (৫০)। পরে তাদের পুলিশের হাতে সোর্পদ করা হয়। আটকের পর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আশু চক্রবর্তীর বাসা থেকেও বিপুল পরিমান ওষুধ জব্দ করা হয়। ওই দুজনকে আটকের পর সরকারি ওষুধ বাইরে বিক্রির সাথে হাসপাতালের কর্মচারী ও অন্যান্য স্টাফের বেশ কয়টি চক্র যে জড়িত, সেটি প্রকাশ্যে আসে। মূলত এরপর থেকেই সরকারি ওষুধ চুরি ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে উঠে চমেক হাসপাতাল প্রশাসন। ঘটনার পরপর চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন, পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের এবং সরকারি কর্মচারী আশু চক্রবর্তীকে বিধি অনুযায়ী চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে হাসপাতাল প্রশাসন। এরপরও আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। ঘটনার পরপরই ২৬নং ওয়ার্ডসহ অন্তত ১০টি ওয়ার্ডের সর্দারকে সরিয়ে দেয়া হয়। আর শৃঙ্খলাজনিত কারণে অব্যাহতি দেয়া হয় আউটসোর্সিংয়ের ৪/৫ জন কর্মচারীকে। তাছাড়া ওষুধ চুরির বিষয়টি ধরা পড়ার পরপরই হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ডের সর্দার, নার্সিং সুপারভাইজার ও বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে আলাদা আলাদা বৈঠক করা হয় বলে জানান হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. অংসুই প্রু মারমা। ২৬নং ওয়ার্ডে আলাদা নজর রাখার কথা জানিয়ে হাসপাতালের উপ-পরিচালক বলেন, আমরা সবার সাথে বসেছি। যারা দীর্ঘ দিন ধরে একই ওয়ার্ডের সর্দার হিসেবে ছিল, তাদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছি। ২৬নং ওয়ার্ডে আলাদা নজর রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে গত ৩১ মার্চ গাইনী ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) পার্শ্ববর্তী প্রি-অপারেটিভ কক্ষের একটি ব্যাগে জমানো বেশ কিছু ওষুধ ও স্যালাইন উদ্ধার করা হয়। সুযোগ বুঝে বাইরে পাচারের উদ্দেশ্যে এসব ওষুধ-স্যালাইন সেখানে জমানো হয়। পরে ওষুধ চুরি চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে আরো কয়েকজনকে আটক করা হয়। আদালতের মাধ্যমে তাদের জেল হাজতেও পাঠানো হয়। এরপরও যেন ওষুধ চুরি থামছে না। তবে নতুন ওষুধ আইন কার্যকর হলে এবার সরকারি ওষুধ চুরির মতো অপকর্ম কমবে বলে আশাবাদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রেনের হুকে আটকে ১০ কিমি ছেঁচড়ে গেল তরুণের দেহ
পরবর্তী নিবন্ধবৃষ্টি ছাড়াই হাঁটু পানি