হৃদয় দোলায়, দোলাও আমারে, তোমারই হিয়ার মাঝে – মীরা

ইশরাত জাহান | শনিবার , ২ জুলাই, ২০২২ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ত্রিপুরার রাজবংশ নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। রাজা-মহারাজাদের জীবনাচরণ নিয়েও আছে অনেক আখ্যান-উপাখ্যান। এসব কাহিনী নিয়ে মানে রাজবংশের ইতিহাসকে আশ্রয় করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা ধর্মমাণিক্যের আদেশে একটি গ্রন্থ প্রণীত হয়। পদ্যে রচিত গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয় ‘রাজমালা’। পরবর্তীতে গ্রন্থটির তথ্য হালনাগাদ করা হতে থাকে। সেই সময় ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট এবং কুমিল্লা। তাই এই বইতে এসব অঞ্চলের ইতিহাসও উঠে এসেছে।

‘রাজমালা’ ছয়টি লহর বা খণ্ডে বিভক্ত। এই খন্ডগুলোর যুগে যুগে আধুনিকীকরণ হয়েছে। রাজবংশেরই একজন কর্মচারী ১৮৯৬ সালে ত্রিপুরার ইতিহাস নিয়ে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটির নামও দেওয়া হয় ‘রাজমালা’। গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন শ্রী কৈলাসচন্দ্র সিংহ। বইটি রচনা করা হয় মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের আমলে। কৈলাসচন্দ্রের বাবা ও ঠাকুরদা ছিলেন মানিক্য পরিবারের সেরেস্তাদার ও মোক্তার। তাই তার ‘রাজমালা’য় ত্রিপুরার ব্যাপারে অনেক অজানা ও মূল্যবান তথ্য উঠে এসেছে।

বীরচন্দ্র মানিক্য রাজা হওয়ার আগে সিংহাসনের আরেকজন শক্ত-পোক্ত উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি শচীন দেববর্মণের বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববাহাদুর; বীরচন্দ্রের সৎভাই। সিংহাসনের অধিকার পাওয়ার লোভ বীরচন্দ্রকে হিংস্র ও নির্দয় করে তোলে। তিনি কয়েকবার নবদ্বীপচন্দ্রকে হত্যার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে নবদ্বীপচন্দ্র রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ কর্মচারী কৈলাসচন্দ্র সিংহের পরামর্শে কুমিল্লায় চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। রাজসিংহাসনের দাবি ত্যাগ করার পর কুমিল্লা শহরের দক্ষিণে চর্থা এলাকায় নবদ্বীপচন্দ্রকে বীরচন্দ্র ৬০ একর জমি দান করেন। এখানে নবদ্বীপচন্দ্র একটি দালান নির্মাণ করেন। এই দালানেই শচীন দেববর্মণের জন্ম হয়।

হ্যাঁ, শচীন দেববর্মণ, তাঁকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেবার দুঃসাহস নাই। ১৯৩৭ শচীন দেবের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ-বছর তিনি তাঁর পরবর্তী সংগীত জীবনের প্রেরণা শ্রীমতি মীরা দাশগুপ্তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তার নাম পাল্টে রাখা হয় মীরা দেববর্মণ। মীরা দেববর্মণ ছিলেন তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্তের নাতনী। পাদপ্রদীপের আলোয় না থাকা এই মানুষটাকে অনেকেই চেনেন না। অথচ, শচীন কর্তার বিখ্যাত সব গানের গীতিকার তিনি।

‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক/পায়েলখানি বাজে/মাদল বাজে সেই সংকেত/কালো মেয়ে নাচে ।/পাগলপারা চাঁদের আলো/নাচের তালে মেশে।।’
এই গানটা শোনা হয়নি, এমন বাঙালি সঙ্গীতপ্রেমী বিরল। এর গীতিকার মীরা, তিনি যে কেবল তাঁর স্বামী শচীন দেববর্মণের গানের নোটেশন সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন তা নয়। স্বামী ও পুত্রের চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দেয়ার মাপকাঠি নির্দিষ্ট করেছিলেন। অবশ্যই নিজেকে প্রচারের আলোয় না এনে, থেকেছেন আড়ালে। অসামান্য সঙ্গীতের বোধ ও শিক্ষা তাঁর ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী। প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন, সেই সঙ্গে যুগের তুলনায় সঠিকভাবে তালিমও পেয়েছিলেন। শচীন দেব বর্মনের যে গান গুলোর সুরের আবেশে মাতাল হই আমরা এবং নিয়মিত গুনগুন করি সেগুলোর অনেক সুর-ই মীরা দেববর্মণের সহায়তায় তৈরি হয়েছে ।

তাঁর সম্পর্কে জানা যায় খুবই অল্প। মীরা দেববর্মণের জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে। ছোটবেলা থেকে দাদু ও দিদিমার বাড়িতে থাকতেন। তাঁর দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট-এর চিফ জাস্টিস। দাদু ও দিদিমার বাড়িতে জন্ম থেকেই থাকা পারিবারিক অসুবিধার কারণে। তারপর কলকাতার সাউথ এন্ডে বসবাস শুরু করেন দাদু দিদিমার সঙ্গে। সেখানে শুরু হয় পড়াশুনো সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত-এর তালিম। দাদু দিদিমার বাড়িতে বিদ্যালয় শিক্ষা ও সঙ্গীত শিক্ষা সমানতালে চলে। দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নাতনীর সঙ্গীত শিক্ষার যথেষ্ট আয়োজন করেছিলেন। পড়নোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি সঙ্গীত শিক্ষা নিতেন। ১৯৩৭ সাল থেকে শচীন দেবের কাছে গান শিখতেন। এ ছাড়াও তিনি সঙ্গীত গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। কীর্তন ও ঠুমরী শেখেন সঙ্গীতাচার্য ধীরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে। ১৯৩০ সালে আনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করেন এবং শান্তিনিকেতনে অমিতা সেনের কাছে নৃত্যে তালিম নেন।

তাঁর বিষয়ে একজন সংগীত বোদ্ধার অভিমত যথার্থই মনে হয়, ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তুখোড় জ্ঞান সম্পন্ন গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, রবীন্দ্রসংগীতেও সমান দক্ষতা, গানের কথাকার হিসেবে আধুনিক মনস্কতা, শব্দের ব্যবহার, মাটির কাছাকাছি থাকার প্রবণতা, অবাক হতে হয়; সহকারি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও চমক দেয়ার মতো সুরের বিভা ছিল তাঁর।’

গান তখনই আপনার আরো কাছের হয়ে ওঠে, যখন আপনি মাটির গন্ধটা মেখে হয়ে ওঠেন রাজসিক। গান আপনার আত্মার আরো কাছাকাছি চলে আসে, যখন আপনি সেটাকে ছুঁতে পারেন। গান তখনই আপনার আরো মনের কাছের হয়ে যায়, যে মুহূর্তে আপনি বলে উঠতে পারেন, আরে এটা তো আমার গান! মীরা দেববর্মণের গানগুলো একদমই তেমন।

এখানে মীরা দেববর্মণ রচিত, শচীন দেববর্মণের সুরে ও কণ্ঠে সুপরিচিত, প্রিয় কয়েকটি গানের প্রথম কলি উল্লেখ করছি ‘বিরহ বড় ভাল লাগে’, ‘গানের কলি সুরের দুরিতে’, ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা’, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’, ‘কালসাপ দংশে আমায়’, ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া’, ‘কী করি আমি কী করি’, ‘না আমারে শশী চেয় না’, ‘নিটোল পায়ে রিণিক ঝিনিক’, ‘শোন গো দখিন হাওয়া’, ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই’ ইত্যাদি।

সেই সময় কজন মহিলা সঙ্গীত পরিচালিকা ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । সময় থেকে সব বিষয়েই এগিয়ে ছিলেন তিনি।স্বাকিয়তা ছিল তার সব সৃষ্টির মূল কথা। নয়া জমানা, তেরে মেরে স্বপ্নে , শর্মিলি ,অভিমান , বারুদ ,প্রেম নগর-এই বিখ্যাত চলচ্চিত্র গুলোর সহযোগী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এই চলচ্চিত্র গুলোর সুরের অভিযান মুখরিত করেছিল সমস্ত শ্রোতাদের। এখনো এগুলো আমাদের কাছে স্বর্ণযুগের গান ।

১৯৭৫ সাল, স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত বম্বের বাড়ি জেটে বাস করেছেন। তারপর পুত্র রাহুলের সঙ্গে রাহুলের ভদ্রাসন মেরি ল্যান্ডে।রাহুল দেব বর্মন মারা গেলেন ১৯৯৪ সালে। পুত্র ও স্বামীর মৃত্যুর অসম্ভব শোক তাকে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় পৌঁছে দিল। এ অবস্থায় তাঁর পুত্রবধু আশা ভোঁশলে তাঁকে রেখে আসেন ভাসি’র এক বৃদ্ধাশ্রমে। ২০০৭ সালের ১৫ই অক্টোবর সেখানে তাঁর জীবনাবসান হয়। ত্রিপুরা সরকার তাঁকে কোন একটা সাম্মানিক পুরস্কার দিতে গিয়ে আরডি-র সান্তাক্রুজের বাড়িতে না পেয়ে অনেক খুঁজে মীরাকে পান সেই বৃদ্ধাশ্রমে, এমনকি সেই আশ্রমের কর্ণধারও জানতেন না তারই বাড়িতে ধুঁকে ধুঁকে শেষ জীবন কাটিয়েছেন এই অসাধারণ গীতিকার।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এ দেশে ছুটে এসেছিলেন। গ্রামের পুকুর পারে দেখতে পেলেন একটি চৌদ্দ-পনের বছরের মেয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন সদ্য মেয়েটির বিয়ে হয়েছে, ভাই আসবে তাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে। সকাল থেকে অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত, ভাইয়ের দেখা নাই। বাড়ি ফিরেই লিখেছিলেন – কে যাস রে ভাটি গাঙ গাইয়া, আমার ভাই ধনরে কইয়ো নাইওর নিতো আইয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা যখন শরণার্থীর হাতিয়ার
পরবর্তী নিবন্ধ‘বোয়ালখালী পৌরসভা হবে নান্দনিক’