শিক্ষা যখন শরণার্থীর হাতিয়ার

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২ জুলাই, ২০২২ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

স্পাইসি রোডের সদস্যদের সাথে আমার প্রথম কাজ ছিল চ্যাংমাই শহরে যেসব সংস্থা বা ব্যক্তি শরণার্থী এবং নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে তাদের খুঁজে বের করা এবং যোগাযোগ করে দেখা করার ব্যবস্থা করা। সবাই মিলে গোল হয়ে বসে একসাথে কাজে বসে গেলাম। সদ্য আঠারো বয়সে পা দেয়া নিনা বা এলিনা, কিংবা পঁচিশের ইয়ান্নিক, আবার মধ্য ত্রিশের আমি, কাজ করতে গিয়ে বা ঘুরতে বের হয়ে এই ব্যাবধান কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি। আমি এত বছর প্রফেশনাল কাজ করে করে শিখেছি, আর ওরা গত এক বছর দেশে দেশে ঘুরে বিভিন্ন সংস্থার সাথে কথা বলে, স্বেচ্ছাশ্রম করে শিখেছে। গুগল করে আমরা মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেলাম সংস্থাগুলো সম্পর্কে। যোগাযোগ করা শুরু করলাম। একই ধরনের সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রথম সুবিধা হল, কোনভাবে একটা সংস্থার কারো সাথে কথা বলা গেলে তার কাছ থেকে অন্যদের সাথে যোগাযোগের উপায় জেনে নেয়া যায়। সেই ভরসায় আমরা যতগুলো প্রতিষ্ঠানের ইমেইল বা ফোন নাম্বার পেলাম সবার সাথেই যোগাযোগ শুরু করলাম। ‘বার্মা স্টাডি সেন্টার’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রথম উত্তর দিল। ওদের সাথে দেখা করার সময় দিন-ক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। এদিকে বিশেষ কাজে ইয়ান্নিককে জরুরিভাবে ব্যাংকক যেতে হবে।

আমার এবং নিনার কাজের অভিজ্ঞতার কারণে আমাদের দু’জনের উপর দায়িত্ব বর্তালো সাক্ষাৎকার নেয়ার, এলিনা ছবি তুলবে।

চ্যাংমাই শহরের একেবারে কেন্দ্রে ‘বার্মা স্টাডি সেন্টার’ এর অফিস। খুঁজে বের করতে অসুবিধা হল না। অফিসে ঢোকার মুখে কয়েকটি পোস্টার। এর মাঝে একটি আমাদের সকলের মনোযোগ কেড়ে নিল। আমরা কিছুক্ষণ পোস্টারের সামনে দাঁড়ালাম। পোস্টারের উপরে বড় করে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘উই স্টপ গ্রোইং হোয়েন উই স্টপ লার্নিং’, পোস্টারের মাঝে বার্মার মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে ‘স্বাধীনতা, মানব অধিকার, শিক্ষা, সম্মান, বিচার’ এমনসব শব্দ দিয়ে। একপলকেই বোঝা যায় ওরা কি বলতে চাইছে আর বার্মায় ওরা কি চায়। একজন স্বেচ্ছাসেবক কর্মকর্তাকে আমাদের সাথে কথা বলার জন্য দায়িত্ব দেয়া হল। তিনি জানালেন ২০১০ সালে এই সংগঠনটি শুরু হয় বার্মার শরণার্থীদের শিক্ষার জন্য। মূল লক্ষ্য ছিল শরণার্থী ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি শেখানো এবং যেহেতু থাইল্যান্ডে অনেক পর্যটক আসে, সেই পর্যটক এবং ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বার্মার এই আটকে পড়া মানুষদের কথা সারা বিশ্বকে জানানো। পরবর্তীতে অনেকে কেবল এই সংগঠনের সদস্যদের ইংরেজি শেখাতেই আসা শুরু করে। এখানে আস্তে আস্তে বার্মার ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি বিভিন্ন বিষয়ের উপর একটি পাঠাগার গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে এটি থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় পাঠাগার যেখানে বার্মা বিষয়ে বই এবং গবেষণাপত্র পাওয়া যায়। এই পাঠাগারে বার্মা সংক্রান্ত ইংরেজি, থাই, এবং বার্মার আন্যান্য লিখিত ভাষার বই দান হিসেবে নেয়া হয়। এটা শুনে ভালোই লাগলো, সবাই যখন কেবল টাকা টাকা করছে, তখন এরা দান হিসেবে নিচ্ছে বই।

তবে টাকাও তারা গ্রহণ করে, কেননা মানুষের সাহায্যেই চলে এই পাঠাগার এবং সংগঠন। চ্যাংমাই শহরে মূলত বার্মার শান, কারেন, কাচিন জনগোষ্ঠীর শরণার্থীরা বাস করে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখানে থাকে না। শরণার্থী বিষয়ে থাইল্যান্ডের অবস্থা বিভিন্ন সময়ে বলেছি। এখানে শরণার্থীর মর্যাদা পেয়েছে কেবন কারেন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, এছাড়া অন্যদের জাতিগোষ্ঠী বা অন্যান্য দেশ থেকে আগত মানুষেরা সাধারণত সরকারীভাবে শরণার্থীর মর্যাদা পায় না। শরণার্থী বিষয়ে থাই সরকারের অবস্থান পরিষ্কার হয়, অনেকটা পক্ষপাতদুষ্ট। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার সহায়তায় তাদের শরণার্থী কার্ড দেয়া হয়, কিন্তু রোহিঙ্গারা সেই কার্ডও পায় না। শরণার্থী কার্ড থাকলেও তাদের প্রতিনিয়ত পুলিশি ঝামেলার ভয়ে দিন কাটাতে হয়। তবে একটা সুবিধা এখানে শরণার্থী ছেলে-মেয়েরা পায়, তা হল শিক্ষার সুবিধা। কেউ যদি থাই ভাষা শিখতে পারে, তাহলে সে বিনা খরচে সরকারি স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারে।

আবার কারো যদি আর্থিক সামর্থ্য থাকে, তবে ইংরেজি মাধ্যমেও পড়ালেখা করতে পারে। ‘বার্মা স্টাডি সেন্টার’ চেষ্টা করছে এখানকার বার্মা থেকে আগত শরণার্থীদের নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে, এবং তাদের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী করে গড়ে তুলতে। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকদের মতে, শিক্ষাই তাদের আধিকার আদায়ের হাতিয়ার। যত বেশি মানুষ উচ্চশিক্ষিত হবে, তত বেশি দুনিয়াতে তাদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে বার্মায়, সে কথা ছড়িয়ে দিতে পারবে, তত বেশি তারা বার্মার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে অধিকার আদায়ে। তাদের কথায়, এখন তারা যে অবস্থায় আছে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এই সংগঠনের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবীরা এখানকার সদস্যদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এর সদস্যেরা থাইল্যান্ডের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষারত। আমরা ওদের জানালাম স্পাইসি রোডের ফেসবুক পেইজে এবং ওয়েবসাইটে ওদের এই উদ্যোগের কথা লেখা হবে, যাতে পৃথিবীব্যাপী আরও অনেক মানুষদের কাছে ওদের কথা পৌঁছে যেতে পারে।

বার্মা স্টাডি সেন্টার থেকে বের হতে হতে বেশ বেলা হয়ে গেল। নিনা, এলিনা এবং আমার খুব ক্ষিদে পেয়ে গেল। এই এলাকায় খুব বেশি উঁচু দালান নেই। একটা শান্ত স্নিগ্ধ পাড়া পাড়া ভাব আছে। কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট পেয়ে গেলাম। থাইল্যান্ডের পাড়ার ভেতরের রেস্টুরেন্টগুলোতে কম দামে ভালো খাবার পাওয়া যায়। এই দোকানে চাইনিজদের ঐতিহ্যবাহী ‘শতবর্ষী ডিম’ পাওয়া যায়। দেখতে কালো রঙয়ের কিছুটা জেলির মত দেখতে এই ডিম। আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম শত বছরের পুরানো এই ডিম এভাবে কেন বিক্রি করছে? এত ডিম সেই শত বছর আগে কেন রেখেছে? এটা খওয়া কি ঠিক হবে? দোকানের বয়স্ক নারী বাবুর্চি হেসে দিল। আমাদের কথা খুব যে বুঝতে পেরেছে তা না। কেবল জানালো এগুলোর নাম শতবর্ষী ডিম, কিন্তু আসলে এগুল ফারমেন্টেড। উনি নিজেই বানিয়েছেন। পরে গুগল করে দেখলাম লবণ, লেবু, আর ছাই মেখে ধানের ভুসির ভেতর কয়েক সপ্তাহ রেখে দিলেই তৈরি হয়ে যায় চাইনিজ শতবর্ষী ডিম। আমার মত নতুনের কাছে রঙ খুব একটা ভালো না লাগলেও খেতে ভালোই লেগেছে- একটু নোনা নোনা আর একধরনের হালকা গন্ধ আছে। খাওয়া শেষে আমরা কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম। আমরা যার বাড়িতে আছি, তিনি অফিস শেষে আমাদের নিয়ে যাবেন। আমরা তার অফিসের সামনের মাঠে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

২০১৭ সালের ভ্রমণ কাহিনী

পূর্ববর্তী নিবন্ধকুমিরকে বিয়ে করলেন মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধহৃদয় দোলায়, দোলাও আমারে, তোমারই হিয়ার মাঝে – মীরা