কবিয়াল ফণী বড়ুয়া। বাংলা কবিগানের কিংবদন্তী শিল্পী। প্রচলিত ধারা ভেঙে কবিগানের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে যে কজন কবিয়াল পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে ফণী বড়ুয়া অন্যতম। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী, প্রগতিপন্থী, আজীবন ত্যাগী ও নিরলস সংগ্রামী জীবন চেতনার প্রতীক, দেশ ও কালের আদর্শ। ফণী বড়ুয়ার জন্ম ১৯১৫ সালে চট্টগ্রামের রাউজানে।
আর্থিক সংকটের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হবার আগেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে হয় তাঁকে। শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। কয়েক বছর বৌদ্ধ শ্রমণ হিসেবে কাটে। একটা সময় আসে যখন স্বস্তি মেলে না। গৈরিক বসন ছেড়ে পাড়ি জমান তদানীন্তন বার্মায়। কাজ নেন স্টিল ট্রাংকে রং করা ও ফুল তোলার। সন্ধ্যার পর বাঙালি কলোনির অবসরে মাঝে মাঝে কবিগানের আসর বসতো। তন্ময় হয়ে শুনতেন কিশোর ফণী। নিজের গানের গলাও ছিল মিষ্টি। বৌদ্ধ কীর্তন গাইবার অভ্যাস ছিল তাঁর। তা দেখে কবিয়াল মতিলাল দোহার হিসেবে ফণীকে সঙ্গী করে নিলেন।
এভাবেই কবিগানে ফণী বড়ুয়ার হাতেখড়ি। পরবর্তীসময়ে কবিয়াল রমেশ শীলকে গুরু হিসেবে বরণ করে কবিয়াল হওয়ার সাধনায় নিজেকে নিবেদন করেন। এই গুরু-শিষ্যকে অবলম্বন করেই কবিগানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। কবিগান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক গণজাগরণের হাতিয়ার, শোষণমুক্ত, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে কবিগানের অনুষঙ্গ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ও চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রচারণার অংশ হিসেবে কবিগান রচনা করায় কবিয়াল ফণী বড়ুয়ার ওপর পাকিস্তান সরকার হুলিয়া জারি করেছিল। কবিগানের পাশাপাশি ফণী বড়ুয়া প্রচুর গান ও কবিতা রচনা করেন।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক গানও রয়েছে। তাঁর প্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে: ‘কবিগান’, ‘দেশের ডাক’, ‘হাল জমানার গান’, ‘জনতার গান’, ‘সর্বহারার জীবন সংগীত’ প্রভৃতি। এইসব রচনায় তাঁর দেশপ্রেম, স্বদেশ চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তবুদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মার্কসবাদে আস্থা, ইতিহাস সচেতনতা প্রভৃতি সুস্পষ্ট। তিনি ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম কিশোর কবিতা সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। সংগীতে গৌরবময় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কবিয়াল ফণী বড়ুয়া ২০০১ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। ২০০১ সালের ২২ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।