ভাসমান মানুষের তথ্য নেওয়ার মধ্য দিয়ে বুধবার প্রথম প্রহরে শুরু হয়েছে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি; ২১ জুন পর্যন্ত এ শুমারির প্রাথমিক ফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও তিন মাস। ভাসমান মানুষের পর বুধবার সকাল ৮টা থেকে সারাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৭ জন গণনাকারী ট্যাব ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গতরাত ১২টা থেকে সারা দেশের ২০ হাজার চিহ্নিত করা ২০ হাজার স্পট থেকে ভাসমান লোক গণনা সম্পন্ন করা হয়েছে। এবং সেসব তথ্য ইতোমধ্যে বিবিএস ডাটা সেন্টারে চলে এসেছে। নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী আজ সকাল ৮টা থেকে মূল শুমারি সুন্দরভাবে শুরু হয়ে গেছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো খবর আমরা পাইনি। এ কার্যক্রমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
জনশুমারি আগে আদমশুমারি নামে পরিচিত ছিল। সর্বশেষ পঞ্চম শুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। প্রতি ১০ বছর অন্তর এ শুমারি হওয়ার কথা থাকলেও মহামারীর কারণে গত বছর তা করা সম্ভব হয়নি। পঞ্চম শুমারিতে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ কোটি। বিবিএস মহাপরিচালক বলেন, প্রত্যেক গণনাকারী নিজ নিজ এলাকায় শুমারির তথ্য সংগ্রহ করছেন। বুধবার শুরু হয়ে টানা সাতদিন তথ্য সংগ্রহ করে আগামী ২১ জুন শুমারি কাজ শেষ হবে।
শুমারির তথ্য সংগ্রহের জন্য ১০০টি খানা নিয়ে এক একটি গণনা এলাকা গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি এলাকার জন্য একজন গণনাকরী নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি কেবল সংশ্লিষ্ট ১০০ খানা থেকেই তথ্য সংগ্রহ করবেন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সারা দেশের এই বিপুল তথ্য সন্নিবেশ করে আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হতে পারে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন। ডিজিটাল এ শুমারিতে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি‘র ইন্টারনেট সংযুক্ত প্রায় ৪ লাখ ট্যাব ব্যবহার করা হচ্ছে। শুমারিতে গণনাকারী ছাড়াও ৬৩ হাজার ৫৪৮ জন সুপারভাইজার, ৩ হাজার ৭৭৯ জন আইটি সুপারভাইজার, তিন হাজার ৭৭৯ জন জোনাল অফিসার, ১৬৩ জন জেলা শুমারি সমন্বয়কারী এবং ১২ জন বিভাগীয় শুমারি সমন্বয়কারী কাজ করছেন।
যেসব তথ্য নেওয়া হচ্ছে
এবারের শুমারিতে মোট ৩৫টি ক্যাটাগরিতে ব্যক্তি ও খানা মডিউল ভাগ করে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। খানা বা বাসাবাড়ির ঠিকানা যেমন- গ্রাম, মহল্লা, বাড়ির নম্বর, ফ্ল্যাট নম্বর হোল্ডিং নম্বর নেওয়ার পাশাপাশি বসতঘরের ধরনও (বস্তি, কুড়েঘর, মাটির ঘর, কাঠের ঘর নাকি দালান) জানছেন গণনাকারী। এরপর সংশ্লিষ্ট খানা প্রধানের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, আপনার অন্য কোথাও বসতঘর আছে কি না?
আবার খানার প্রধান বসতঘরের দেয়ালের উপকরণ যেমন- কংক্রিট, টাইলস, টিন, কাঠ, বাঁশ নাকি চাটাই যেমন জানতে চাওয়া হচ্ছে, তেমনই ছাউনি কিসের (কংক্রিটের ছাদ, ছন, তালপাতা, গোলপাতা নাকি পলিথিন) তারও তথ্য নেওয়া হচ্ছে। সংগ্রহ করা হচ্ছে খানায় বাসগৃহের সংখ্যা, ভবনের মোট তলার সংখ্যা, বাসগৃহের মালিকানা, খাবার পানির প্রধান উৎসের মতো তথ্য। টয়লেট সুবিধা, টয়লেট ব্যবহারের ধরন, সাবান ও পানিসহ হাতধোয়ার পৃথক ব্যবস্থা আছে কি না, সে তথ্যও জানছে বিবিএস।
খানায় বিদ্যুৎ সুবিধা আছে কি না, থাকলে উৎস কী? রান্নার জ্বালানির প্রধান উৎস কী? খানায় কোনো ক্ষুদ্র গৃগোষ্ঠীর সদস্য আছে কি না- এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে খানা প্রধানকে। খানায় কোনো বিদেশি নাগরিক আছে কি না তা জানতে চাচ্ছে গণনাকারী। আবার খানায় কী ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, গত দুই বছরে খানায় কোনো বৈদেশিক রেমিটেন্স গ্রহণ করা হয়েছে কি না- তার তথ্যও নেওয়া হচ্ছে।
শুমারির রাতে খানায় অবস্থানকারী সদস্য (আত্মীয় ও অনাত্মীয়) সংখ্যা, শুমারির রাতে খানায় অনুপস্থিত (ভ্রমণরত বা ডিউটিরত) সদস্য সংখ্যা, খানায় অন্তর্ভুক্ত মোট সদস্য সংখ্যা পূরণ করতে হচ্ছে ট্যাবে। একটি খানায় কতজন বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে থাকেন, গত দুই বছরে খানার কতজন সদস্য বিদেশ থেকে স্থায়ীভাবে ফেরত এসেছেন- এসব তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর ব্যক্তি মডিউলে রয়েছে খানা সদস্যদের নাম, বয়স, লিঙ্গ। খানা প্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক। বৈবাহিক অবস্থা। ধর্মীয় পরিচয় যেমন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য। খানায় কোনও প্রতিবন্ধী সদস্য আছে কি না, তার তথ্য নেওয়া হচ্ছে। থাকলে কী ধরনের যেমন- অটিজম, শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ বা অন্যান্য।
খানার সদস্যদের মধ্যে ৫ বছরের বেশি বয়সীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা বর্তমান অবস্থায় বিদ্যালয়ে যাচ্ছে কি না, সে তথ্যও নেওয়া হচ্ছে শুমারিতে। যেমন- একজন সদস্য পড়তে ও লিখতে পারেন কি না। পড়াশোনা করেছেন কি না। সর্বোচ্চ কোন শ্রেণি পর্যন্ত পাস করেছেন। পাসের ক্ষেত্র যেমন- সাধারণ, কারিগরি নাকি ধর্মীয়।
কাজের মর্যাদা যেমন- খানার কোনও সদস্য কর্মরত থাকলে তার কাজের ধরন, কাজের ক্ষেত্র। বর্তমানে কোনো প্রশিক্ষণে নিয়োজিত আছেন কি না- এসব তথ্যও নিচ্ছেন গণনাকারী। জানতে চাওয়া হচ্ছে কোনও সদস্যের নিজস্ব ব্যবহারের মোবাইল ফোন আছে কি না। মাসে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন কি না বা বিগত ৩ মাসের মধ্যে অন্তত একবার ইন্টারনেট, ফেইসবুক, ইউটিউব বা হোয়াটসআপসহ এ ধরনের ফিচার ব্যবহার করেছেন কি না। ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়েছেন কি না।
পরিবারের ১৫ বছরের বেশি বয়সী সদস্যদের কারও ব্যাংক, বিমা, সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট আছে কি না তাও জানতে চাওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, রকেট ও নগদ অ্যাকাউন্ট আছে কিনা তাও সংগ্রহ করছেন গণনাকারীরা। ক্ষুদ্র গৃগোষ্ঠীর হয়ে থাকলে কোন গোষ্ঠীর তাও সুনির্দিষ্ট করে সংগ্রহ করা হচ্ছে। সবশেষে জাতীয়তার তথ্য নিয়ে বাংলাদেশি হলে কোন জেলায় তা নির্বাচন করা হচ্ছে। আর বিদেশি হলে কোন দেশের নাগরিক, সে দেশের নামও পূরণ করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন বলেন, গণনাকারীর হাতে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) যুক্ত ট্যাব সরবরাহ করা হয়েছে। ট্যাবে এমন সফটওয়্যার যুক্ত করা হয়েছে যাতে সকল তথ্য পূরণ না করে কিংবা কোনো খানা থেকে তথ্য না নিয়ে সংশ্লিষ্ট গণনাকারী ‘কাজ শেষ’ বলে ট্যাব জমা দিতে পারবেন না।
প্রশ্নপত্র পূরণ হওয়ার সাথে সাথে তা সয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটের ডাটা সেন্টারে জমা হচ্ছে। সেখান থেকে আগামী ২১ জুনের মধ্যে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডাটা সেন্টারে জমা হবে।