লোক ঐতিহ্যের চিরায়ত কাহিনী

সৌভিক চৌধুরী | শুক্রবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজি ভাষায় যা লিজেন্ড বা লোকাল ট্র্যাডিশন, বাংলায় তাকে আমরা বলি কিংবদন্তি। লোকাল ট্র্যাডিশনকে লিজেন্ডের সমার্থক হিসেবে ধরা হয়। যার বাংলা ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, পূর্বকালে কথিত বা জনশ্রুত কোন লোকঐতিহ্য বা কাহিনী এমনভাবে উত্তরকালে প্রবাহিত হয়েছে যা মানুষের মনে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে এবং স্থানীয়ভাবে সে কাহিনী ব্যক্ত হয়েছে পরম্পরায়। কিংবদন্তি তৈরি হতে পারে ঐতিহাসিক পরম্পরায়, যা মানবচিত্তে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায় এবং স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নামকরণের মাধ্যমে বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে। ইতিহাসের আবহমানতায় প্রেম, বিচ্ছেদ, কিংবা ট্র্যাজেডির চিরন্তন উপকরণগুলো জনশ্রুতির মাধ্যমে সামাজিকভাবে রূপলাভ করে এবং সময়ের বিবর্তনে তা লোকাল ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক শহর চট্টগ্রামের স্থানীয় নামকরণের পেছনে কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে অনেকখানি। এই শহরের বিভিন্ন স্থানের নামের মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘কিংবদন্তির গল্প’, যার লেখক প্রয়াত ছোটগল্পকার সুচরিত চৌধুরী। বইটি ১৯৯৩ সালে বেরোয় বাংলা একাডেমি থেকে। এতে মোট ১১ টি গল্প গ্রন্থিত হয়েছে। যেগুলো চট্টগ্রাম শহরকে ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত করেছে পাঠকের কাছে। গল্পের কাহিনি নিছক কল্পনাপ্রসূত নয় বরং এমন এক কিংবদন্তির প্রেক্ষাপটে রচিত যা পাঠককে স্পর্শ করে গভীরভাবে। লোকচিত্তে ধারণ করা লোকজ উপাদান গুলো যুগ পরম্পরায় চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়ে এক ঐতিহ্যের স্মারকে পরিণত হয়েছে। কিংবদন্তির এসব ইতিহাসকে সুচরিত চৌধুরী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গাল্পিক অবয়বে রূপদানের মাধ্যমে রচনা করেছেন প্রেম, বিরহ আর ট্র্যাজেডির নিখুঁত কাহিনী।
‘লালদীঘি ‘ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প। নামটি শুনলেই বোঝা যায় এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিদ্রোহ এবং বেদনার অবিমিশ্র রূপ। কেনই বা এর নাম লালদীঘি হয়েছিল, নানা ধরনের গল্প ঘুরে বেড়াত মানুষের মুখে-মুখে। কেউ বলত কোন চারণ কবি হয়ত লালদীঘির আগুনজ্বলা রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কেউ বলত খুনে লাল হয়ে গিয়েছিল দীঘির পানি। মূলত এই গল্পটি রচিত হয়েছে এক রাজকীয় প্রেমের রহস্য নিয়ে। গল্পটিতে বিধৃত হয়েছে লাল বেগমের প্রতি এক যুবক বাদশার অনুরাগের কাহিনী। যে লাল বেগমকে বাদশা ভালোবাসতেন, সে একদিন বাদশারই অজান্তে মুল্লুক থেকে পালিয়ে যায় এক ক্রীতদাসের সাথে। কিন্তু বাদশার লাল বেগমকে চাই। অগত্যা বুড়ো মন্ত্রি মশাই এক যুবতী নারীকে নিয়ে এলেন লাল বেগমের পরিচয়ে। তাকে পেয়ে যুবক বাদশার মন ভরে গেল আর দেখতে লাগলো তার রাজত্ব। কিন্তু একদিন সেই যুবতীর আসল পরিচয় পেয়ে গেল বাদশা। আসল লাল বেগমের খোঁজে সে হামলা চালায় পর্তুগীজদের কেল্লায়। প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হল। সে যুদ্ধে খুনে লাল হয়ে গেল দীঘির পানি। পরাজিত বাদশা পালাতে পারল না। তার প্রতীক্ষা শুধু লাল বেগমের জন্য, অনন্তকাল ধরে। লাল বেগমের প্রতি বাদশার অকৃত্রিম প্রেম তার অপেক্ষার পালাকে শেষ হতে দেয়নি। গল্পকার এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন এক নিখাদ প্রেমের ইতিহাস। এখানে তিনি লিখেছেন সেই যুবক বাদশার উক্তি “না আমি পালাতে পারিনা, আমি যে বাদশা, আমি এই দীঘির পারে লুকিয়ে থাকব, যতোদিন লাগে লাগুক, লাল বেগমকে ওই কেল্লা থেকে উদ্ধার করে আমি ফিরে আসব। ‘লাল বেগমের প্রতি বাদশার অকৃত্রিম প্রেমের অনুরণনে মূর্ত হয়ে উঠেছে আজকের ‘লালদীঘি’।
‘পরীর পাহাড় ‘গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প। এক সময় পরীর পাহাড়ে সূযের্র আলো মুছে যাওয়ার সাথে সাথে পরীরা নাকি হেসে খেলে নেচে বেড়াত আর সূযের্র আলো দেখা দেয়ার আগেই চলে যেত। সারাটা দিন ঘুমিয়ে থাকতো সেই পাহাড়। সন্ধ্যা হলেই পরীদের পায়ের স্পর্শে জেগে উঠত এভাবে এ পাহাড়ের নাম হয়ে গেল পরীর পাহাড়। লেখক বলেছেন এ পাহাড়ের নাম কে রেখেছিলেন জানি না। যিনি রেখেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই পরীদের রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিংবদন্তি বলে, তার নাম মজু গায়েন। পরীর পাহাড়ে অসংখ্য নারীর আনাগোনা। সেখানে থাকতো এক মগরাজা। একদিন মগরাজার সেপাইরা ধরে নিয়ে গেল মজু গায়েনকে। সেখানে মগরাজাকে গান শুনিয়ে কপাল খুলে গিয়েছিল মজু গায়েনের। সেই থেকে সে রাজসভার গায়ক। মগরাজার কাঠের ঘরের চারপাশে নেচে বেড়াতো সুন্দরী নারীরা । মজু গায়েনের সাথে পরিচয় হয় এক সুন্দরী নারীর। সেই নারীকে বিয়ে করতে চায় মগরাজা। কিন্তু মগরাজার রাণীরা বেশিদিন বাঁচেনা। সে নারী নিজেকে বাঁচানোর আকুতি জানায় মজু গায়েনের কাছে। তাকে বাঁচানোর জন্য মজু গায়েন ওস্তাদের কথা মত পাহাড়ে চেরাগ জ্বালিয়ে দিল। রাতের অন্ধকারে সে চেরাগগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলে। আর তা দেখে দরিয়ার ছুলুপ থেকে হার্মাদ দস্যুরা ছুটে এল, শুরু হল মগরাজার সাথে যুদ্ধ , পালিয়ে গেল মগরাজা। সে সাথে পালিয়ে গেল সুন্দরী মেয়েরা। কিন্তু পালাতে পারল না সেই সুন্দরী নারী। কৃতজ্ঞতায় সে মুখ লুকালো মজু গায়েনের বুকে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ একটি গুলি এসে লাগলো সুন্দরীর বুকে। ডানা মেলে সে উড়ে গেল আকাশের দিকে। সেই থেকে মজু গায়েন সুন্দরীর নাম দিল পরী, আর পাহাড়টার নাম দিল পরীর পাহাড়। মজু গায়েন ভুলতে পারেনি সে পরীর কথা। ভুলতে পারেনি সেই পরীর আকাশের দিকে চলে যাওয়ার কথা। লেখক এখানে মজু গায়েনের অন্তরের এক শূন্যতার বিরাজমানতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পের অবয়বে যা কিংবদন্তির পরীর পাহাড়কে নিয়ে যায় এক ঐতিহাসিক চেতনায়।

‘টাইগার পাস’ গল্পটি সাদা বাঘের কাহিনীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাঘ কখনো সাদা হয় না। কিন্তু এ-গল্পে এটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই সাদা বাঘকে ঘিরে রচিত হয়েছে ত্রিভুজ প্রেমের কিংবদন্তির গল্প। পাহাড়ের এক কোণে মকবুল, অলি আর সকিনার বাস। নির্জন পাহাড়ি এলাকায় বাঘের আনাগোনা। বাঘ শিকারীর ছেলে মকবুল বুকে অদম্য সাহস, সকিনাকে সে মনে মনে ভালোবাসে। কিন্তু এ-কথা বলার সাহস তার নেই। কিন্তু সকিনার বিয়ে ঠিক হয় অলির সাথে। বাঘগোনার আশেপাশে পাহাড়ি অঞ্চলে দিনেদুপুরে বাঘের আনাগোনা বেড়ে যায়, বিদেশি শিকারীরা বাঘের ডাক শোনার সাথে সাথে শিকারে বেরিয়ে পড়ে। তাই তারা এলাকার নাম রেখেছিলো ‘টাইগার পাস’। এমনই এক সাহেবের সাথে মকবুল আর অলির পরিচয়। সাহেবের বন্দুক দেখে মকবুলের মনে পড়ে যায় তার বাবার কথা। বিলাতি পুলিশের এক কুকুরকে মারতে গিয়ে তার বাবা হারিয়েছিল হাতের আঙুল , তখন তিনি মকবুলকে বলেছিলেন, ‘ব্যাটা বন্দুক দিয়ে মারবি তো মারবি বাঘ, কুকুর কোনদিন মারবি না। ‘সেই কথা মনে করে মকবুল সাহেবের বন্দুকটি তুলে নিলো বাঘ শিকারের জন্য। মাচায় উঠে অলির সাথে মকবুল অপেক্ষা করছিল বাঘের জন্য। অলির অন্তরে সকিনাকে বিয়ে করার বাসনা, কিন্তু সে বিশ্বাস করে সকিনা ভালোবাসে মকবুলকে। এই কথাটি মকবুলকে বলতেই বাঘ ডেকে উঠলো। নিচে পড়ে গেল অলি। পশু আর মানুষের আর্তনাদে এক সময় নিস্তব্ধ হয়ে আসে চারদিক। মকবুলের মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠে। সে অলির মায়ের কাছে ছেলের বীরত্বগাথা শোনায়। কিন্তু মকবুলের অন্তর্দহন জাগিয়ে তোলে নিজের বিবেককে। অলির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল মকবুল চাপা স্বরে বলে ‘অলি, মাচা থেকে লাফ দেবার আগে যে কথা তুই বলেছিলি তা আমি কোনদিন সকিনাকে বলতে পারবোনা। ‘মকবুল উপলব্ধি করতে পেরেছিল অলির কথাগুলো। অলি বিশ্বাস করত সকিনা ভালোবাসে মকবুলকে। কিন্তু মকবুলের ভিতরে বোধশক্তি এক অজানা সংকোচের কাছে পরাজিত হয় বারবার ।
‘দেওয়ানহাট’, চট্টগ্রাম শহরের একটি পরিচিত এলাকা। এখনকার বটতলী স্টেশনের তখনো জন্ম হয়নি। রেল লাইনও স্থাপিত হয়নি। কাছেই ডাকাতের বিল। রাস্তা থেকে কিছুদূরে কসাই দেওয়ান আলীর চালাঘর। পর্তুগীজ সর্দার গঞ্জালিশ আর রাজা কিরণচন্দ্র দেওয়ানের মধ্যে বিরোধ। একদিন রাতে কিরণচন্দ্র পালিয়ে আশ্রয় নেয় দেওয়ান আলীর ঘরে। তখনো কিরণচন্দ্রের পরিচয় অজানা দেওয়ান আলীর কাছে। গঞ্জালিশের সেপাইরা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। দেওয়ান আলীর সহৃদয়তা কিরণচন্দ্রকে রক্ষা করে সেপাইদের হাত থেকে। একদিন রাজা কিরণচন্দ্র সস্ত্রীক দেওয়ান আলীকে আমন্ত্রণ জানায় তার প্রাসাদে। দেওয়ান আলীর কাছে সে কৃতজ্ঞ। তাই রাজা চাইছেন তাকে একখন্ড জমি উপহার দিতে। দেওয়ান আলী জমি পেয়ে মহাখুশী। সে রাজাকে জানালো এই জমিতে সে হাট বসাবে। কারণ হাট হল মানুষের মিলনমেলা। ঝড় এলে, তুফান এলে একসঙ্গে সবাই রুখে দাঁড়ায়। দেওয়ান আলীর এই যে মিলনমেলার চেতনা, ঐক্য গড়ার বাসনা, এটাই ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার। দেওয়ান হাটের দেওয়ান আলীর বিবেক আর সামাজিক ঐক্যের চেতনা কিংবদন্তি হয়ে আছে যুগযুগ ধরে।
কিংবদন্তির গল্পগ্রন্থের আরেকটি গল্প ‘কালুরঘাটের বিরিজ’। কর্ণফুলী বয়ে চলেছে চট্টগ্রাম শহরের গা-ঘেঁষে। শান্ত একটি নদী তার উপর ব্রিটিশদের নির্মিত একটি সেতু, যার নাম কালুরঘাটের বিরিজ। গল্পের ভেতওে আছে মানবতা, আছে ট্র্যাজেডি। এই গল্পটি কালু মাঝির জীবনের পরিসমাপ্তির করুণ ইতিহাস। কালু মাঝির করুণ পরিণতি বিলিতি ইঞ্জিনিয়ারের মনকেও নাড়া দিয়েছিল। ইতিহাস গড়া এই ব্রিজটি ‘কালুরঘাটের বিরিজ’ নামে কিংবদন্তি হয়ে রইল। কিংবদন্তির গল্পগুলোর বাঁধুনি অত্যন্ত সহজ ও সরল এবং যতটা সম্ভব পাঠকপ্রিয় করার প্রয়াস পেয়েছেন গল্পকার সুচরিত চৌধুরী। গল্পগুলো এক সময় ধারাবাহিক নাটক হিসেবে ‘ধ্বনি প্রতিধ্বনি ‘অনুষ্ঠানমালায় প্রচারিত হত চট্টগ্রাম বেতারে। এ-গল্পগ্রন্থটি চট্টগ্রাম ‘বাতিঘর’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে পুনঃপ্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানের নামকরণের মাহাত্ম্য আমাদের অনেকেরই অজানা। কিংবদন্তির গল্পের মাধ্যমে নামকরণের রহস্য উন্মোচিত হয় অনেকখানি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করা ঠিক নয়
পরবর্তী নিবন্ধছেঁড়া কাগজের গান