আমাদের আলোর পথযাত্রীরা একে একে চলে যাচ্ছেন। আমরাও ক্রমশঃ দিশাহীন হয়ে পড়ছি। মাথার উপরের ছাদটাও সরে যাচ্ছে। সামনে তাকালেই দেখতে পাচ্ছি যোজন শূন্য প্রান্তর। স্নেহ মায়া মমতা; সহজাত এই প্রবৃত্তি গুলোও বিলীন হয়ে চলেছে তাঁদের চলে যাওয়ার পথরেখা ধরে।
বেগম মুশতারী শফী, আমার প্রাণপ্রিয় খালাম্মা চলে যাওয়ার পর এই অসীম শূন্যতা বুকে ‘বড়ো বেদনার মতো’ বেজে চলেছে। সুখে দুঃখে ছুটে যাওয়ার শেষ আশ্রয়টুকু আর রইল না।
মুশতারী খালাম্মার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ১৯৮৩ সালের দিকে চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সূত্রে। ক্রমশ সেই সম্পর্ক সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। পরিচয়ের সময় তিনি খালাম্মা থাকলেও অল্পদিনের মধ্যে মাতৃসমা হয়ে উঠেছিলেন। কারণ আমাদের পরিবারটিও মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিবারগুলির একটি। মিজোরামের শরণার্থী শিবিরে আমি হারিয়েছি শিশু তিন ভাই ও দুই বোনকে। হারিয়েছি চট্টগ্রাম শহরে আমাদের ঘরবাড়ি। খালাম্মার পরিবারটিরও মুক্তিযুদ্ধে বিপর্যস্ত। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও বাড়িতে অস্ত্র রাখার অভিযোগে পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালে ৭ এপ্রিল খালাম্মার স্বামী ডেন্টাল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফী ও খালাম্মার একমাত্র ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এহসানকে ধরে নিয়ে যায়। ওঁরা আর ফিরে আসেননি। মুশতারী খালা পুত্র কন্যাদের নিয়ে তারপর দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেক দূর দূরান্ত ঘুরে আগরতলা হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন। আগরতলায় আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্যে স্থাপিত হাসপাতালে সেবিকা এবং কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দ সৈনিক হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় নিয়োজিত ছিলেন। অল্প বয়সে স্বামীহারা এই মহিয়সী নারী শতকষ্ট অপমান, অবহেলা সহ্য করে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষায় তিন পুত্র চার কন্যাকে মানুষ করেছেন রেডিয়োর চাকুরিকে সম্বল করে। উঠে দাঁড়িয়েছেন আবার। সোচ্চার হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার স্বপক্ষে। অগ্রবর্তিনী থেকেছেন সমস্ত সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনে। সদা প্রতিবাদী থেকেছেন সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। লেখনীর মধ্য দিয়ে সবকিছু লিপিবদ্ধ করে গেছেন চরম সাহসিকতার সঙ্গে। মাথা নোয়াননি কারো কাছে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উপেক্ষা করেছেন সমস্ত হুমকি, প্রলোভন, উপহাস প্রতিনিয়ত।
দুজনে আমরা দুজনের জীবনের গল্প করেছি কত সকাল দুপুর সন্ধ্যা। ক্রমশ আমি হয়ে উঠেছি তাঁর আরেকটি সন্তান। তাঁর সঙ্গে দিনের পর দিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা গল্প করতে-করতে একসময় তাঁকে নিয়ে ছবি করার কথাটি বলি। ২০০৪ সালের দিকের কথা। প্রথমে রাজি হননি। ধীরে ধীরে রাজি করিয়েছিলাম। তারপর ২০০৫ থেকে ২০০৭ এই তিন বছর ধরে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছি। তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রে আমার বন্ধুরা দিনের পর দিন আমাকে সহযোগিতা করে গেছে। খালাম্মার পরিবারের অকুণ্ঠ সহযোগিতাও পেয়েছি দীর্ঘ সময় ধরে। ৮০ মিনিটের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ‘বিস্তৃত অধ্যায়’ মুক্তি পায় ২০০৭ সালের ১১ মে।
ছবিটি করতে গিয়ে সহযোগিতা যেমন পেয়েছি, তেমনি সুধী অসুধী বিভিন্ন মহলের প্রচুর অসহযোগিতা, সমালোচনা, কটূকথা সহ্য করতে হয়েছে। অনেক হুমকির মুখোমুখি হয়েছি দুজনে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার বিভিন্ন শহরে প্রদর্শিত হয়েছে এ ছবি। ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি শহরে ছবিটি প্রদর্শিত হলেও আরো বিশদভাবে ছবিটি প্রদর্শিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে জমা দিয়েছিলাম। তারা ছবির বিভিন্ন অংশ নিয়ে আপত্তি তুলে ঐসব অংশ বাদ দিয়ে দেখানোর প্রস্তাব দিলে আমি সম্মত হতে পারিনি। পরে আমি ‘বিস্মৃত অধ্যায়’ ইউটিউবে আপলোড করে দিয়েছি যাতে ছবিটি সবার কাছে পৌঁছে যেতে পারে এবং সবাই এই মহিয়সী নারীকে চিনতে ও জানতে পারেন।
সাধারণভাবে বেগম মুশতারী শফী মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় আন্দোলনকারী, সমাজকর্মী, নারীনেত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, বেতার ব্যক্তিত্ব, কথক, সাহিত্যিক, শিক্ষক ইত্যাদি অভিধায় ও পরিচয়ে পরিচিত। কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয়- তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সেই সন্ধিক্ষণ ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময় থেকেই তিনি সাংস্কৃতিকভাবে এর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন নিজের বুদ্ধিবৃত্তিতে। স্বামী ডাঃ শফীর উৎসাহের পাশাপাশি তাঁর নিজের সচেতনতাও এই সম্পৃক্ততার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তখন তিনি চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন (বেতারের চাকুরিতে যোগ দেন স্বাধীনতার পরে-মূলত জীবন ধারণের প্রয়োজনে)। তিনি বেতারকেই তাঁর আন্দোলনের ক্ষেত্র করে নিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জন্ম নিয়েছিল ‘চট্টগ্রাম শহরের এনায়েত বাজারের মুশতারী লজে, যেটি বেগম মুশতারী শফীর বাসভবন। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান-পরিকল্পনা, অনুষ্ঠান-বিন্যাস,পাণ্ডুলিপি রচনা সব ঐ বাসাতেই হয়েছে; ডা. মোহাম্মদ শফী, বেগম মুশতারী শফী, বেলাল মোহাম্মদ সহ অন্যদের সমন্বয়ে। অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে প্রথমে আগ্রাবাদ ও পরে কালুরঘাট প্রেরণ কেন্দ্র থেকে। কালুরঘাটে বোমাবর্ষণের পর বেতারকেন্দ্রটি প্রথমে আগরতলা ও পরে কলকাতায় স্থিত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যেটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ওয়ারফ্রন্ট, সেখানে বেগম মুশতারী শফী স্বনামে বেনামে অনুষ্ঠান করে গেছেন শেষ পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম শহরে তাঁদের বাড়ি মুশতারী লজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি সংযোগকেন্দ্র । মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেই এই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা জমা রেখেছিলেন প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, যা পাকিস্তানি সেনারা কারো বিশ্বাসঘাতকতায় জেনে যায়। অবশ্য বাড়িটার আশেপাশে অনেক অবাঙালি বাস করতেন। কোনোভাবে হয়তো ওরা টের পেয়েছিল। তাছাড়া অনেক আগে থেকেই এই বাড়িটি ছিল চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের সম্মিলনীস্থল। এই বাড়িতেই গড়ে উঠেছিল বান্ধবী সংঘ, বান্ধবী পত্রিকা এবং মেয়েদের প্রেস। বঙ্গবন্ধু এসব কারণে মুশতারী শফীকে ডাকতেন ‘চট্টলার বান্ধবী’।
আজো এ-বাড়িতে রয়েছে শিশুদের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় যার প্রধান শিক্ষায়িত্রী ছিলেন তিনি। রয়েছে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ বাড়িটি চট্টগ্রামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চার বাতিঘর। বাড়িতে রয়েছে বিশাল এক গ্রন্থাগার। এ-বাড়ির গৃহিণী বেগম মুশতারী শফী, স্বাধীনতার পর সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাংসারিক প্রাত্যহিকতার পাশাপাশি। বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে সেই থেকে শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত ছিলেন প্রতিনিয়ত। জীবনের শত ঝুঁকি ও হুমকিকে অবহেলা করে ১৯৭২ সাল থেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে লিখে গেছেন অবিরাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে পালন করে গেছেন অগ্রণী ভূমিকা। ঘাতক দালাল নির্র্মূল কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়াসহ এতদবিষয়ে নানাবিধ কাজকর্মে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের আনাচে কানাচে এবং বিদেশে। উদ্দেশ্য একটাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রচার এবং তার মূল্যবোধে সব প্রজন্মকে পুনরায় এবং নতুন করে উজ্জীবিত করা; যে মূল্যবোধ, চেতনা ও স্মৃতি আমরা বিস্মৃত হয়েছি। এক্ষেত্রে তিনি জাহানারা ইমামের পাশে ছিলেন এবং তাঁর প্রয়াণের পর সে দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নেন। তাঁদের সে প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং নিজের দেশ সম্পর্কে ক্রমান্বয়ে উৎসুক উজ্জীবিত হয়ে উঠছে।
বেগম মুশতারী শফীকে শহীদজায়া, শহীদভগ্নী এসব আবেগ সম্পন্ন অভিধায় সম্বোধন করে সম্মানিত করা সমীচীন নয়। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, অকুতোভয় একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। যদিও এর যথাযথ স্বীকৃতি তিনি পাননি অজানা কারণে। বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ কিংবা বেগম রোকেয়া পদক তাঁর সাহসী অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে নিতান্ত। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ দুই পদকের কোনোটাই তাঁর ভাগ্যে জোটেনি যার তিনি প্রকৃত দাবিদার।
খালাম্মার সঙ্গে আমার যোগাযোগ চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সূত্রে। তাঁর চলচ্চিত্রানুরাগ এবং চলচ্চিত্র বোধ বিভিন্ন সময়ে আমাকে অবাক করেছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্রাভিনয় শিল্পী এমনকি অনেক কলাকুশলী সম্পর্কেও তিনি রীতিমতো ওয়াকিবহাল ছিলেন। আমাদের বিভিন্ন প্রদর্শনী এবং উৎসবে পুত্রবধূদ্বয়সহ তাঁর উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত নিয়মিত। তাঁর লেখার পাঠকমাত্রই জানেন কত স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল তাঁর গদ্য। ইচ্ছে করলেই তিনি অনেকের চেয়ে ভালোভাবেই চলচ্চিত্র বিষয়ে লিখতে পারতেন। তাঁর সঙ্গে চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা করার সুযোগ পেয়ে এ বিশ্বাস জন্মেছে আমার। অনেকবার বলা সত্ত্বেও লেখেননি।
পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে হলেও তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মালদহে ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। তাঁর পিতা তখন মালদহে কর্মরত ছিলেন। তিন মাস বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ২০ তারিখে তাঁর প্রয়াণ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
বেগম মুশতারী শফী আপোষহীন, অকুতোভয়, স্পষ্টবাদী, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন প্রকৃত দেশনেত্রী একজন মানুষ; যিনি নিজেই কেবল মাথা উঁচু করে চলেননি, আমাদেরও ঐভাবে চলতে শিখিয়েছেন, সততা আর সাহসের সঙ্গে বাঁচতে শিখিয়েছেন, জীবনকে ভালোবেসে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যেতে শিখিয়েছেন। আলোকবর্তিকা হয়ে এই জননী সাহসিকা সবসময় আমাদের পথ দেখিয়ে যাবেন।