মহান আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু কবে, কখন এ বিশ্ব সৃজন করেছেন তার কোন হিসেব নেই। মহাকাল তথা বিশ্ব সৃজনের সময় আলোক বর্ষের হিসেবে বিশ্লেষণ করলেও কোন কুল-কিনারা পাওয়া যায় না। ‘জন্মিলেই মরিতে হয়’- এ সত্যটি সকলেরই জানা, এটা সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পবিত্র কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা‘আলা ফরমান ‘কুল্লু নাফসীন যায়িকাতুল মাউত-জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। [সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৮৫]
অবধারিত সত্য কথাটি আমরা অবলীলাক্রমে ভুলে যাই (শয়তান ভুলিয়ে দেয়)। একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য মানব সন্তানের পৃথিবীতে আগমন ঘটে। সেই নির্দিষ্ট সময়কালকেই বলা হয় আয়ু। মানুষের বয়স বৃদ্ধি পায়, আসলে হ্রাস পায়। একশত বছর আয়ুষ্কাল নিয়ে কেউ জন্মালে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাইনাস হতে থাকে। পঞ্চাশ বছর বয়স হলে বাকী রইল পঞ্চাশ। দেখা যায় বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হ্রাসের প্রশ্নও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবার সব মানুষের আয়ু সমান হয় না। আল্লাহ্ পাক যার জন্য যতটুকু বয়স (মেয়াদকাল) বরাদ্দ করেন সে সময়কালটাই শুধু মায়াবী পৃথিবীতে থাকতে পারেন। এ সম্পর্কে ক্বোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘‘তিনি তোমাদের মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এককাল নির্দিষ্ট করেছেন এবং আর একটি নির্ধারিত কাল আছে, যা তিনিই (আল্লাহ্) জ্ঞাত।’’ [সূরা আনআম: আয়াত-২]
এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের দুনিয়াবী (পার্থিব) জীবনের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে দেন। অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে (ইল্লা বিইযনিল্লাহ্) কারও মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু তার মেয়াদকাল অবধারিত। কেউ পার্থিব প্রতিদান চাইলে আমি (আল্লাহ্) তার কিছুই দেই, আর কেউ আখিরাতের প্রতিদান চাইলে আমি (আল্লাহ্) তার কিছুই দেই এবং কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করব।’’ [সূরা আল ইমরান: আয়াত-১৪০]
মৃত্যু মানুষের পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটালেও অনন্ত জীবনের দিকে মানব সত্তার পথ করে দেয়। প্রিয়নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন ফরমান, ‘‘পৃথিবী হচ্ছে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র, অতএব পৃথিবীতে সৎকর্ম কর যাতে আখিরাতে পুণ্যের ফসল কাটতে পার।’’ সোবহানাল্লাহ্! দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কোরআন মজীদে উল্লেখ রয়েছে, এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের আর আখিরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস।’ [সূরা মু’মিন: আয়াত-৩৯]
ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সহজ-সরলভাবে নির্বাহ্ করা, সৎচিন্তা ও সৎকর্মের দ্বারা সুশোভিত করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জীবনের স্বার্থকতা। সহজ-সরল জীবন যাপনের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধের সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটে। একজন সত্যনিষ্ঠ প্রজ্ঞাবান ও কঠোর সংযমী মানুষের নিকট পার্থিব জীবনে বিলাস-বসন, ঐশ্বর্য্য, বিত্তবৈভব আকর্ষণীয় হতে পারে না। এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘‘যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিকট পার্থিব জীবন মনোমুগ্ধকর। তারা বিশ্বাসীদের ঠাট্টা বিদ্রুপ করে থাকে। অথচ যারা ‘তাকওয়া’ অবলম্বন করে তারা কিয়ামতের দিন তাদের (বিদ্রুপকারী) উর্ধ্বে থাকবে।’’ [সূরা বাক্বারা, আয়াত- ২১২]
‘‘পার্থিব জীবনতো আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগমাত্র।’’ [সূরা রা’দ : আয়াত-২৬]
‘‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে মুত্তাকি তার জন্য আখিরাতই উত্তম।’’ [সূরা নিসা: আয়াত-৭৭]
‘‘আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগের উপকরণ অকিঞ্চিৎকর’’ [সূরা তাওবা: আয়াত-৩৮]
যারা সংযমী, যারা পার্থিব জীবন অতিবাহিত করে সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে, যারা যা বৈধ তা গ্রহণ করে এবং যা অবৈধ তা বর্জন করে, যা ন্যায় তা করে, যা অন্যায় তার কাছে ঘেষাও হয় না, যারা সৎ কাজে আদেশ করে এবং অসৎ কাজ করতে নিষেধ করে, যারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে এবং আল্লাহর রসূলের সুন্নাহর পায়রবী করে, যারা ছোট-বড় ও সন্দেহ যুক্ত যাবতীয় পাপকার্য থেকে নিজেকে নিভৃত করে চলে তাঁরাই মুক্তাদিদের অন্তর্ভুক্ত।
তাকওয়ার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা জানতে গিয়ে একদা সৈয়্যদুনা হযরত ওমর ফারুক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উবায় ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাকওয়া’ কি? উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি কি কখনো কণ্ঠকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন? হযরত ওমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, ‘হ্যাঁ। হযরত উবায় ইবনে কা’ব আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সে কণ্ঠকাকীর্ণ পথ কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন? হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, ‘আমি সাবধনতা অবলম্বন করে দ্রুত গতিতে ওই পথ অতিক্রম করেছিলাম।’ তখন হযরত উবায় ইবনে কা’ব বললেন, এটাই তাকওয়া! সুবহানাল্লাহ্। পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে তাকওয়া সম্পর্কে জোর তাগিদ রয়েছে। এটা নিশ্চিত জানতে হবে যে, কোন মানুষই চিরকাল পৃথিবীতে থাকে না, থাকতে পারে না। নির্ধারিত সময়ে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয়। আল্লাহ্ এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয়ই যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না এ পার্থিব জীবনেই পরিতুষ্ঠ এবং এতেই পরিতৃপ্ত থাকে ও যারা আমার নির্দেশনাবলী সম্বন্ধে অমনোযোগী, ওদেরই আবাসস্থল হচ্ছে আগুন, ওদের কৃতকর্মের জন্য।’’ [সূরা ইউনুচ, আয়াত-৭-৮]
‘‘যারা পার্থিব জীবনকে আখিরাতের চেয়ে ভালবাসে, মানুষকে নিবৃত্ত করে আল্লাহর পথ হতে এবং আল্লাহর পথ বক্র করতে চায়, ওরাই ঘোর বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’’ [সূরা ইবরাহীম: আয়াত-৩]
পার্থিব জীবন আলস্য ও হেলাফেলায় কাটানোর জন্য নয়, এটা হচ্ছে কর্মের জীবন আর সে কর্ম অবশ্যই হতে হবে সৎকর্ম (আমালুস্ সালিহ্)। এ জীবন মানব কল্যাণের জন্য, এই জীবনে ভোগ বিলাস করার অবকাশ নেই। একজন পরিচ্ছন্ন, বিত্তবান ও সত্যনিষ্ঠ মানব সত্তার হৃদয়ে ভোগ বিলাস ঠাঁই লাভ করতে পারে না।
এ জীবনে জীবিকা নির্বাহের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত সবটুকু অন্যের প্রয়োজন মিঠানোর উদ্দেশ্যে দান করে দেয়ার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ যাকাত দ্বারা বিত্তবানদের ধন সম্পদ বিত্তহীন, সর্বহারা ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বন্টন করে দেয়ার বিধান রয়েছে এবং এর দ্বারা গরীব মিসকিনদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ক্বোরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে ‘‘তাদের (বিত্তবানদের) ধনসম্পদে ন্যায্য অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের।’’ [সূরা যারিয়াত: আয়াত-১৯]
ধন-সম্পদ থেকে কতটুকু দান করতে হবে তা জানার জন্য একবার আকায়ে মাওলা তাজেদারে মদীনা হুযুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, (হে রাসূল) লোকে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে কি ব্যয় (দান) করবে? আপনি বলুন, ‘যা উদ্ধৃত্ত। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-২১৯]
এ আয়াত করীমার মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, কর্তব্যবোধ এবং সহজ-সরল জীবন-যাপনের তাগাদা দেয়া হয়েছে।
সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার শ্রদ্ধাস্পদ মাশায়েখ হযরাতগণ কুতুবুল আউলিয়া আওলাদে রসূল, হাফেজ ক্বারী আলহাজ্ব সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি, কুতুবুল এরশাদ, হযরতুল আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও গাউসে যামান হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) বায়আত করার পূর্বে তাওবা করান এই বলে- ‘‘হাম ওহ্ কাম করেঙ্গে জিসসে আল্লাহ-রসূল রাজী হোঁ, আউর ওহ্ কাম নেহী করেঙ্গে, জিসসে আল্লাহ্-রসূল নারাজ হোঁ।’’ এ দু’টি বাক্যের মধ্যে সব কথা উচ্চারিত হয়েছে। মিথ্যা বলা, পরনিন্দা চর্চা, উপহাস করা ক্ষমতা জাহির করা, পীর ভাইবোনদের অবমূল্যায়ন করা, গালমন্দ করা প্রভৃত্তি উপরোক্ত তাকওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা কি বলছি, কি করছি স্বার্থ হাসিল ও ধান্দাবাজ কিনা এটা জগত যেমন দেখছে, তেমনি মুর্শিদ ক্বিবলাও অবগত আছে। একসময় বিস্ফোরিত আগ্নেয়গিরীর লাভা সবাইকে (অমান্যকারী) ভস্মীভূত করে দেবে। সুতরাং আমাদের উচিত হবে সময় থাকতে সাবধান হওয়া, যাতে করে আল্লাহ তা‘আলার গজব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের অসন্তুষ্টি ও মুর্শিদের অশুভদৃষ্টি থেকে নাজাত পেতে পারি।
মহান রাব্বুল আলামীন শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করে আমাদেরকে তাঁর রাসূলের আদেশ নির্দেশ মেনে সত্য ন্যায়ের পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট।