একজন আলোকিত মানুষ অধ্যাপক খালেদ

ড. আনোয়ারা আলম | মঙ্গলবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ


কিছু কিছু মানুষ এ পৃথিবীতে জন্ম নেন সমাজকে আলোকিত করার জন্য, যাদের সততা, মানবতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ত্যাগের আদর্শ ফুলের সুবাসে সমাজ নামক বাগানকে সুরভিত করে, তেমনি একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। বর্তমান সময়ের প্রবাহে একজন নিখাদ মানুষের কথা ভাবতে গেলে অসহায় বোধ করি। কথা ও কাজে, আচার ও ভূষণে, বিনয় ও চারিত্রিক দৃঢ়তায়, আদর্শে ও নীতিতে, কঠিন সত্যির মুখোমুখিতে নির্ভীক একজন সোনার মানুষ ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ।
সুদীর্ঘ জীবনের পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন ভূমিকায় তাঁর পথচলা। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি অনন্যসাধারণ। একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম একজন প্রণেতা, বঙ্গবন্ধুর অতি আপনজন তিনি নিজস্ব প্রজ্ঞা ও দক্ষতায় একজন নীতিবান রাজনৈতিক নেতা। যিনি রাজনীতি করেছেন দেশের জন্য, এলাকার জন্য কিন্তু জাগতিক জীবনের লোভ বা মোহ তথা অর্থ ক্ষমতা ও গদি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন সযত্নে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ভক্তি শ্রদ্ধা বিশ্বাস ও আনুগত্য ছিল অপরিসীম, এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তবে বিরোধীদের প্রতি তাঁর সহনশীলতা ছিল প্রবাদপ্রতিম। এটাই তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য।
রাজনীতি ও সমাজসেবাকে তিনি সমানভাবে গুরুত্ব দিতেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যেমন দেশের একজন সংবিধান প্রণেতা তেমনি দুঃখী মানুষের প্রতি তাঁর অনুভূতি ছিল সুগভীর। কৃষক ও কৃষির উন্নয়নের জন্য আদর্শ গ্রাম প্রকল্পের প্রণয়ন করেন। ১৯৭৭ সালে তাঁর অনুপ্রেরণায় চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি হাসনাত আবদুল হাই সমগ্র চট্টগ্রামের আদর্শ গ্রাম আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। খালেদ সাহেব বহুবার বাঁশখালি থানার চেচুরিয়া আদর্শ গ্রাম প্রকল্পে যান। এ প্রকল্পের সাফল্যের জন্য এই গ্রামের মানুষের কাছে তিনি এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নির্দিষ্ট আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা ও আনুগত্য যে কোনো মানুষের ব্যক্তিগত নীতি, মানসিক স্বচ্ছতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার মাত্রার পরিচায়ক। নানা উত্থান-পতন, বিপর্যয় এবং দুঃসময়ের মধ্যে ও নিজের দলের নেতা ও দলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। আদর্শ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ‘৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামাজিক -সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে অবক্ষয়, যে কারণে আরেক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে অন্য এক বেদনার প্রতিচ্ছবি সেখানে রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের ও নেতিবাচক পরিবর্তন। বদলে যেতে থাকে মানুষের মধ্যে মানুষ। এই প্রান্তিক সময়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। নিজেকে নিয়ে থিতু হন পত্রিকা সম্পাদনার কর্ম প্রক্রিয়ায়।
তিনি একজন আপোসহীন সাংবাদিক হিসেবে জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজাদীর সম্পাদক।
‘আমার সাংবাদিকতায় আসাটা একেবারে আকষ্মিক। সাংবাদিকতায় আসবো সেরকম পূর্ব পরিকল্পিত ধারণাই আমার মধ্যে ছিল না। আকস্মিকভাবে এসেছি, এসেই চল্লিশ বছর এই আজাদী পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত রয়ে গেলাম। আমার বিশ্বাস, পত্রিকা জাতীয় জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সত্য ভাষণ দিয়ে থাকে এবং তা জাতির উন্নতি সাধনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। একটা সুন্দর জীবনবোধের আলোকে জনবল, জনমত গঠন করার জন্য যে কাজটুকু করা দরকার সেটার জন্যই আমি সংবাদপত্রে আজ পর্যন্ত জড়িয়ে আছি এবং আমি বিশ্বাস করি এর মাধ্যমে জাতি উন্নত হতে পারবে’।(সাক্ষাৎকার : চট্টল চিত্র, আট এপ্রিল ২০০০)
সংবাদপত্রে সংবাদ পরিবেশনার মূলনীতি হলো, প্রাপ্ত তথ্য-শ্রুত-দৃষ্ট বিষয়ের পক্ষপাতহীন নৈর্ব্যক্তিক শব্দ-চিত্র অংকন, যাতে পাঠক সংশ্লিষ্ট বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা লাভে সক্ষম হন। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা একটা শিল্প। চট্টগ্রামের এই শিল্প অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। সংবাদ পরিবেশনা ও সম্পাদকীয় মন্তব্য উভয় ক্ষেত্রে তিনি সবার অনুকরণীয় আদর্শ ও পথপ্রদর্শক।
মানুষ হিসেবে তিনি একবাক্যে অতুলনীয়। বিনয়ী তবে স্পষ্ট বক্তা তথা সত্য উচ্চারণে সাহসী। যুক্তিসমৃদ্ধ মনোগ্রাহী ভঙ্গিতে অল্প সময়ে যথাযথ বক্তব্য প্রদানে তিনি ছিলেন এক অসাধারণ বক্তা। সবার সম্মান বা শ্রদ্ধার পাত্র হতে হলে সাধনার প্রয়োজন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন আমার কাছে এক সাধক তুল্য মানুষ। নিয়মানুবর্তিতা তাঁর বিশেষ গুণ। শুদ্ধ জীবনাচরণে, নৈতিকতায়, ভাষণের পাণ্ডিত্যে মনে হতো তিনি যেন বিবেকের কণ্ঠস্বর। মানুষকে বড়ো করে দেখা এ ছিল তাঁর বিশেষ গুণ।
তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে গেলে মনে হতো এক বটবৃক্ষের ছায়া। সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, বিজ্ঞান, মানবতা বাদ যেন তাঁর চরিত্রে মিলেমিশে একাকার। অভিজাত নম্রতায় তিনি এই শহরের প্রাণ ছিলেন। আমার পরম সৌভাগ্য তাঁর স্নেহ এবং সান্নিধ্যে আমি একজন ভাগ্যবান মানুষ।
যথার্থ গুণের মানুষ দেশের কালের উর্ধ্বে মৃত্যঞ্জয়। তিনি তেমন এক মানুষ যিনি নক্ষত্রের মতো বাংলাদেশের আকাশকে আলোকিত করেছেন। এমন অনুকরণীয় মানুষের অভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করছি। পরিশেষে এই পরিশুদ্ধ মানুষের প্রতি জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেই শিক্ষা ভুলিনি-ভুলব না
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল