ইতিহাসের আগ্নেয়গিরি ফুুড়ে বেরিয়ে জন্ম নেয়া একটি দেশ এর নাম বাংলাদেশ। সময়ের অগ্রিগর্ভ থেকে জন্ম লাভ করা দেশের নাম বাংলাদেশ। বিশ্বের বুকে এক অনন্য নজির বাংলাদেশ। প্রাচীন দিনের ভোরে গঙ্গা ব্রক্ষপুত্র অববাহিকায় গাঙ্গেয় ‘ব’ দ্বীপ চেহারা নিয়ে কখনো বঙ্গ, কখনো বাঙ্গালা, কখনো বাংলা এবং সময়ের পরিণতিতে হয়ে ওঠা নাম বাংলাদেশ। ইতিহাসের ঐতিহ্যের ভূমি রাঢ়, সমতট, বঙ্গ, হরিকেল, বরেন্দ্র ভূমির অংশ নিয়ে উঠা বাংলা ভূগর্ভে ধরে রেখেছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আর ভূপৃষ্ঠে অনন্য শোভাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। যুগে যুগে কবি ও শিল্পীদের মনে জ্বালিয়েছে প্রেরণার দ্বীপ্তি, ভাবুকদের অন্বেষায় এ দেশ সম্পদ সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের এক মহাপৃথিবী। বর্তমান সময়ের সভ্যতার ধারক বাহক ইউরোপের মানুষ যখন ছিল অরণ্যচারী, পর্বত গাত্র ও বৃক্ষে তাদের নিবাস খাদ্য অখাদ্যে জীবন যাপন তখন এ দেশের ময়নামতি, রামকোট, সীতাকোট বিহারে ছিল সর্বোন্নত মানের বিশ্ববিদ্যালয়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থেকে শিক্ষার্থীরা আসত অধ্যয়নের জন্য, জ্ঞান অন্বেষায়। ইউরোপ যখন ছিলো জঙ্গল গ্রামে ভরা তখন এ দেশে ছিল বিকশিত নগর সভ্যতা। পুন্ড্রবর্ধন ছিল বাংলার প্রধান নগর। আরো বেশ কিছু নগর বাংলা জুড়ে ছিল। আমাদের দেশের নদী সাগর পথে সপ্তডিঙ্গা, মধুকর ময়ুর পঙ্খী বাণিজ্যতরী দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হতো নানা ফলমূল এ দেশের মশলা, জাফরান, চাল, পাট, মসলিন। ভ্রমণ প্রেমিক ইবনে বতুতাসহ সব ভ্রমনকারী স্বীকার করেছেন বাংলায় একবার প্রবেশ করলে স্বদেশে দিয়ে যাওয়া কষ্টকর।
সে সব সোনালী গৌরব নিয়ে আমাদের দেশ টিকে থাকতে পারেনি। বহিরাগত সম্পদলোভী ক্ষমতা লোলুপ হরেক দেশের বণিক ও রাজ শক্তি বার বার হানা দিয়ে এ দেশ দখল করেছে। কু্ক্িষগত করেছেন সম্পদ, কেড়ে নিয়েছে শাসন ক্ষমতা। অবশেষে হলো দেশের হর্তাকর্তা ভাগ্য বিধাতা। মানুষ রুখে দাঁড়ালো চললো আন্দোলন, সংগ্রাম। যুগের পর যুগত, শতাব্দীর পর শতাব্দী। অবশেষে দেশ মুক্ত হল বেনিয়া শক্তির ও ভিনদেশী রাজশক্তির কবল থেকে। ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষন সময়ে পাকিস্তান নামক এক অদ্ভূত রাষ্ট্রের অর্ন্তভুক্ত হলো আমাদের দেশ পূর্ব পাকিস্তান নাম নিয়ে। দেখাগেল এ রাজশক্তি ধর্মের আলখেল্লা পরা রহস্য ও ভৌতিক উপন্যাসের ঐন্দ্রজালিক ত্রাস সৃষ্টি করা দানবদের মত ভয়ঙ্কর পৈশাচিক শক্তি। শুরু হল বাঙ্গালীদের উপর নানা অজু হাতে নির্যাতন নিস্পেষণ। সাথে আছে রাজ শক্তির সহযোগী ড্রাকুলা-ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন। দেশপ্রেমিক নেতাদের করা হচ্ছে গ্রেফতার, আটক। আবার দেশের মানুষ জেগে উঠল। রুখে দাড়ালো আন্দোলন সংগ্রামে, ঝাপিয়ে পড়লো মুক্তিযুদ্ধে বিপুল বিক্রমে তারা অবাক হল। বিশ্ব অবাক হলো। দেখলো কিভাবে বাংলার দারিদ্র পীড়িত কৃষক শ্রমিক সহ নানা পেশার জীবন যোদ্ধা মানুষ আমিত তেজ নিয়ে যুদ্ধ করতে পারে। অন্যতম শ্রেষ্ট চিত্রশিল্পী এস.এম. সুলতান গ্রামীন পেশাজীবীদের বিশাল দেহ ও বিশাল পেশিবহুল ছবি একেঁছেন। আসলে তিনি দেখিয়েছেন বিশাল অন্তর্নিহিতশক্তির অধিকারী এসব জীবন যোদ্ধা মানুষ। এই অন্তর্নিহিত শক্তির বলে নদীবহল বাংলাদেশের পলিমাটির মত কোমল মনের মানুষ বিশাল শক্তি ও তেজ নিয়ে অন্যায়, অসাম্য, অবিচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যময় বাংলাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সৃষ্টি করে।
স্বাধীনতার পর বিশ্বপ্রিয় দেশনায়ক এসে বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তুপের নির্মম শিকার স্বদেশে ফিরে এসে ধাপে ধাপে সুস্থ স্বভাবিক স্বনির্ভর দেশ গড়ে তোলার পদ্ধতি নিয়ে এগুচ্ছিলেন যেমন করে এক নিপূন কারিগর ইটের পর ইট সাজিয়ে যাবতীয় বস্তুর মিশ্রণে এক সুরম্য দালান তৈরী করে কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বধীনতা বিমুখ দেশনায়কের উপকার ভোগী, শত্রু সেবী গোষ্ঠী দেশনায়ককে স্বপরিবারে বধ করে দেশের রাষ্ঠীয় আদর্শকে সমুলে বিনষ্ট করার চেস্টায় উঠে পড়ে লাগে দীর্ঘ তিন দশকের কাছাকাছি সময় ছিল তাদের পৈশাচিক বিচরণ। রাষ্ট ক্ষমতার প্রশাসনে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে ছিল সেসব ড্রাকুলা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনদের আকাশচুম্বী আস্ফালন। দূর্যোগ অন্ধকার তাগুবের একাট নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। মেয়াদশেষে দেখা দেয় সোনালী সূর্যের হাসি, বয় শান্তির অনাবিল সুবাতাস। বাংলাদেশে ফিরে এসেছে নিয়মতান্ত্রিক শাসনের ধারায়। দেশের জীবনে প্রবাহ চলছে এখন এক সুনির্দিষ্ট গতিপথে। মানুষের সার্বিক জীবনধারায় এসেছে নতুন গতি। দেশের কয়েকটি সীমান্ত প্রান্তের জনগন ছয় শতক ধরে পরিচয়হীনতার জটিলতা ও জীবনের বিপর্যয় ভোগ করছিল। সরকারের আন্তরিক কুটনৈতিক প্রচেষ্টায় তারা পেল জীবন ঠিকানা। তাদের ভাগ্যাকাশে সমুজ্জল সুবাতাস। সুনির্দিষ্ট হল আমাদের সাগর সীমানা। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীতে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলাদেশ এখন পা রেখেছে সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরে। দেশের বিভিন্ন স্থরে বিস্ময়কর সাফল্যের সাক্ষী আমাদের দেশ। বর্তমান বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। স্বাধীনতা কালে ছিল ১১০ ডলার। জিডিপি ছিল ৯ মিলিয়ন ৭ ডলার, বর্তমানে ৩৩৫ বিলিয়ন ডলার। খাদ্য উৎপাদন ১ কোটি দশ লাখ টন থেকে ৫ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম। ছাগলের দুধ, কাঁঠাল, তৈরী পোশাক প্রভৃতি উৎপাদন ও আউটসোর্সিং এ বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে। মিঠা পানির মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে। ধান ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে। আলূ উৎপাদনে ষষ্ঠ স্থানে আছে। বিশ্বের ১১৮টি দেশে বাংলাদেশ তৈরী ঔষধ রপ্তানি করছে। যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু, হাইওয়ে, ফ্লাইওভার নির্মাণ বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির উজ্জ্বল উদাহরণ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার হৃ্রাস, শিশু স্বাস্থ্য যত্ন, দারিদ্র বিমোচন সহ আরো কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের ছেয়ে এগিয়ে আছেন বলে মত প্রকাশ করেছেন। আরেক ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আগাম দেখতে পাচ্ছেন। অথচ ১৯৭২ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিন্ডার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি ও অন্দকার ভবিষ্যতের দেশ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভের দিকে বাংলাদেশ অনেক দেশকে ডিঙ্গিয়ে সামনের কাতারে এসেছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রির্জাভের পরিমান ছিল ৪২.৫ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানের বাংলাদেশের রির্জাভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের পরিমাণ ২০.১৫২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এখন ৪১ তম অবস্থানে আর পাকিস্তান আছে ৪৮ তম অবস্থানে। বর্তমানের সুখি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০১ তম স্থানে আর ভারত ১৩৯ তম অবস্থানে সর্বোচ্চ সুখীদেশ ফিনল্যান্ড। দুইজন নোবেল বিজয়ীর ভালোবাসায় সিক্ত বাংলাদেশ। কবি রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের কুস্টিয়ার শিলাইদহে পল্লী ব্যংক স্থাপন করেছিলেন গ্রামীন জনগণের দারিদ্র বিমোচনের জন্য। ড. অমর্ত্য সেন গবেষণা করেছেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সৃষ্ট দর্ুর্ভিক্ষ নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের সেবা ধন্য, ড. অমর্ত্য সেনের সনদ ধন্য বাংলাদেশ যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। জাতিসংঘ হতে উন্নয়নশীল দেশের সনদ পাওয়া বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির বর্তমান শিখর থেকে মহাশিখরে উঠতে গেলে আরো অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, অধ্যাপক