কোন এক ডিসেম্বরে আমি ফোন করেছিলাম ব্রুস উ ইলসনকে। ব্রুস তখন লন্ডনের এক নার্সিং হোমে। রোগশয্যায় থাকলেও তাঁর রসবোধের কমতি ছিলোনা। নাম শুনে পদবী শুনে বললেন, তুমিতো হিন্দু বৈদ্য সমপ্রদায়ের। আমি চমকে উঠেছিলাম। যেসব পরিচয় দেয়া এক ধরণের তুচ্ছতা তাও জানেন তিনি। আমার ফোন করার কারণ ছিলো এই মানুষটি ষোল ডিসেম্বরে রেসকোর্স ময়দানে হাজির ছিলেন। যুদ্ধের পুরো সময়টা মুক্তিবাহিনীর সাথে কাটানো ভদ্রলোক আত্মসমর্পনের খবর কাভার করতে গিয়েছিলেন তাদের সাথে। মেলবোর্ণ এজ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুস উইলসন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক ও বটে। যিনি নয়মাস ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে আমাদের যোদ্ধাদের সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁকে যোদ্ধা বলার বিকল্প কোথায়?
তিনি আমাকে এমন কিছু ঘটনার কথা বলেছিলেন যা ছিলো অশ্রুত। কাদের সিদ্দিকী তখনো বিতর্কিত কেউ না। অথচ এই ভদ্রলোক আলাপে বারবার তার কথা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। একসময় আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম কেন? হাসতে আসতে জানিয়েছিলেন অতি আবেগের যোদ্ধা বা অতি উৎসাহী কাউকে তিনি তেমন গুরুত্ব দিতে রাজী নন । তখন না বুঝলেও এখন বুঝি কেন তিনি তা বলেছিলেন। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এ কে খন্দকারের কথা বলছিলেন। তাঁর মতে এই মানুষটি ই জানেন সত্যিকার ইতিহাস। যিনি সে সন্ধ্যায় উপস্িহত ছিলেন সেই মাঠে। জানিনা আজ ব্রুস উ ইলসন বেঁচে আছেন কি না। মনে হয়না তিনি আর দুনিয়ায় আছেন। থাকলে তাঁকে একটা কথা বলতাম সেই এ কে খন্দকার ও আজ পথভ্রষ্ট। জানিনা কোন কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লিজেন্ডরা এমন পথ হারিয়ে ফেলেন। অথচ একাত্তরের সেই দিনগুলোতে জাতি ঝলসে উঠেছিল খাপ খোলা তরবারীর মতো। আমাদের ভেতর তেমন কোন বিভেদ বা অনৈক্য ছিলোনা। ধীরে ধীরে আমরা এমন এক অন্ধকার জগতে প্রবেশ করেছি যেখানে বন্ধু শত্রূ একাকার। যেখানে আমরা সবাই আজ কোন না ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বিজয় দিবসে আমি বালক ছিলাম। কিন্তু আমার বুদ্ধি বা বোঝার রাস্তা তখন খুলে গিয়েছে। একথা তাই নিশ্চিন্তে বলতে পারি বাঙালি আজ ভাবতেও পারবেনা কেমন ছিলো সে সময়ের জনমত। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি বঙ্গবন্ধুকে কেউ বিতর্কিত করতে পারে। তাজ উদ্দীন আহমেদের মত নেতা চলে যাবেন বিস্মৃতির আড়ালে। অথচ সেটাই সত্য । আরো নির্মম এই, খালেদা জিয়া একজন সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর করুণ দিনে কেক কাটতে পারেন। ভাবিনি একজন সৈনিকের ঘোষণা উঠে আসবে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে। এরপর আমাদের অতীতকে টেনে হিঁচড়ে নামানো হবে অন্ধকারের অতল গর্ভে। তাই তারুণ্যকে আমরা ঢালাও দোষারোপ করতে পারিনা। কিন্তু এটা মানতোই হবে তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে বিভ্রান্ত । শেখ হাসিনার পরপর দু দফা দেশ শাসনে মিডিয়া ও দেশজুড়ে অবারিত স্বাধীনতার ইতিহাস দেখার পর জানার পর ও অন্ধকার যায়নি। কেন? তবেকি এটাই মানতে হবে আমাদের ভেতর কোথাও কোন বড়ধরণের ত্রুটি ছিলো? না আমরা আসলে এই বিজয়ের এমন পরিণতি চাইনি? এখন এই প্রশ্নের উত্তর জানার সময় এসেছে।
কোন জাতি সারাজীবন তার ইতিহাস নিয়ে যুদ্ধ করতে পারেনা। তার সুবর্ণ অতীত বা গৌরবকে কেবল মুষ্টিমেয় মানুষ কলংকিত করেছে এটা এখন মানা মুশকিল। ইতোমধ্যে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশের লেজ ও খসে পড়েছে। গজিয়েছে নতুন নতুন লেজ। যে লেজে পাকি গন্ধ। যে সব আচরণে দেশবিরোধিতা প্রকট। তাই জানা দরকার এ কি পাকিস্তান ভাঙার মনোবেদনা? না এর পেছনে আছে অন্য কোন ইন্ধন। অনেকে বলেন ভারত যেহেতু হিন্দুপ্রধান দেশ তার কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় মেনে নেয়া বুকে শেলের মতো বিঁধে ধাকে। কারো কারো মতে দেশ স্বাধীনের পর ভারতের ভূমিকা দায়ী। অথচ এর একটাও যুক্তিতে টেকেনা। কারণ দেশ স্বাধীনের পর ভারত যদি আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরায় তা হয়েছে আমাদের দুর্বলতায়। রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য আর অসমঝোতার জন্য আমরা কোন বিষয়ে একমত হতে পারিনা। সেখানে ভারত একা না মিয়ানমার ও আমাদের ভুগিয়েছে। ভোগায়। কিন্তু তার বেলায় এমন উগ্রতা নাই আমাদের। মনস্তত্ব কি বলে জানিনা আমার ধারণা সামপ্রদায়িকতা একটা বড় বিষয় হলেও এর পেছনে আছে ইন্ধন আর ষড়যন্ত্র। যা বিনা উস্কানীতেও দিনের পর দিন বছরের পর বছর বয়ে চলেছে ধমনীতে। এবারের নির্বাচনের আগে আমরা দেখছি উন্নয়ন অগ্রগতির পর ও মানুষ কোন না কোন কারনে মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে আমলে নিতে পারছেনা। নিলে জয়ের পথ জয় বাংলার পথ কেউ আটকাতে পারতোনা।
আজকাল গণতন্ত্র আর মুক্তচিন্তার নামে বাঙালি কোন জগতে বসবাস করে বা তার মনে কি আছে জানা দুস্কর। একদিকে সংস্কার আরেকদিকে বাড়াবাড়ি । সাথে জুটেছে বয়স হয়ে যাওয়া প্রবীণ নেতাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা। সব মিলিয়ে উইলসনের বাংলাদেশ আমাদের এই অষ্ট্রেলিয়ার মাটিতে শায়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ডের বাংলাদেশ আগের জায়গায় নাই। দেশে এখন আওয়ামী লীগ দেশশাসনে থাকায় বিজয় দিবস ধুমধামের সাথে পালিত হয়। অথচ দেশের বাইরে ও তার ব্যবহার সীমিত। যে উৎসবটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার যার উদযাপনে বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দ আর জয় ধরা দেবার কথা তা হয় নিতান্ত দায়সারা গোছের। এতেই প্রমাণিত আমরা বিজয় দিবস মানি বিজয় তেমন করে ধারণ করি না। করলে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে সকল বিতকের্র অবসান ঘটতো।
বড় মায়ার দেশ আমাদের। সমাজে এখনো মানুষের মনে মায়া আর ভালোবাসাই মূখ্য। দিনদিন নানা ঘটনায় টাল খাওয়ার পর ও আমরা দেশপ্রেমী। আর কোন জাতিকে আমি দুচোখের জলে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেখিনা। দেখিনা ছোট একটি দেশের জন্য এত বড় বড় বুকের মানুষদের পাগলামি। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু দেশপ্রেমের কারনে ভালো করে সংসার ও করতে পারেননি। আমাদের নেতা তাজ উদ্দিন কিংবা সৈয়দ নজরুলেরা সেই কবে প্রাণ দিয়ে গেছেন। যখন তাদের পরিবারে সময় দেয়ার কথা তখন তারা পরপারে। আমাদের তরূণেরা ভাষার জন্য জান দিয়েছিলেন। আমাদের যুবকরা স্বাধীনতার জন্য এক কাপড়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। তারা জানতেন কি হতে পারে। কিভাবে তারা পাক বাহিনীর মত শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বেন। তারপর ও কেউ থেমে থাকেননি। বীরাঙ্গনারা ইজ্জত দিলেও সম্মান লুন্ঠিত হতে দেননি। এই রক্তভেজা মাটি কারো দয়ার দান না। আমরা ছিনিয়ে নিয়েছি। আমাদের মুক্তি কোন কাগুজে চুক্তিতে আসেনি। হায়েনার মুখ থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে আনতে জানা জাতি সামান্য কারণে তুচ্ছ স্বার্থে দেশের বিজয়কে হেলা করবে এটা মানিনা।
সাগর যাআর বন্দনা রচে শত তরঙ্গভঙ্গে
আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই নাগেরি মাথায় নাচি।
জয় বাংলার অনন্ত উৎসে শুভ হোক বিজয় আমাদের।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক