বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক যদি মুজিবীয় আদর্শকে ধারণ করে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয় তবে ইনশাল্লাহ আমাদের এই দেশ একদিন সোনার বাংলায় পরিণত হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির হাত ধরে এখনো স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী হয়ে এদেশ ও জাতির ভাগ্যোন্নয়নে তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশংসনীয়। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার কার্যকরের মাধ্যমে এদেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিতে চিহ্নিত করে এদেশকে কলঙ্কমুক্ত করার চেষ্টা করছে। একজন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসার আদর্শে এদেশে নারী উন্নয়নের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেছেন। নারীদের উপযু্ক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। নারীর যথার্থ ক্ষমতায়নের মাধ্যমে এদেশের নারীশক্তিকে দেশের উন্নয়নে সম-অধিকার, স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই মুজিবীয় বর্ষের প্রধান উদ্দেশ্য হোক-সকলের সম অধিকার সম কর্ম ক্ষমতায় এদেশের গণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন।
বাঙালির ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস, ২৩ বছরের অন্যায় অত্যাচারের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ৬ দফার ইতিহাস, ৬৯ এর গণআন্দোলনের ইতিহাস, ৭১ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এত সব ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি ও মূলশক্তি হচ্ছে আমাদের বঙ্গবন্ধু। প্রতি বছর সেই ১৯৭১ সালের পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা আমাদের জাতীয় দিবসগুলো পালন করে আসছি। বিশেষ করে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্ভর বিজয় দিবস। অনেক বছর এভাবে দিবসগুলো পালিত হয়ে আসছে। পরবর্তীতে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালিত হচ্ছে। এগুলো জাতীয় দিবস। আর জাতীয় দিবসগুলোর সরকারি ছুটি ঘোষণা থাকলেও স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালগুলোতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়। এই দিবসগুলো পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই দিবসের তাৎপর্য জানা। আমরা জানি, এই দিবসগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা’। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের আদি হতে অন্ত পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জনের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা একক, অনন্য, অপরিসীম, অদ্বিতীয় এবং প্রশ্নাতীতভাবে সর্বজন স্বীকৃত একটি উপাখ্যান। সেই ছোট বয়স থেকে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের সুখ-দু:খ, আনন্দ বেদনা-চাওয়া-পাওয়ার অংশীদার হয়েছে। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কলেজ জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি দেশ ও দশের সাহায্য ও সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন। শৈশবে তার মানবিক গুণাবলী সকলের নজরে পড়ে ছিল। তার আজন্ম প্রতিবাদী স্বভাব সেই শৈশবেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরবর্তীতে একে একে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে কখন যে এক মহান নেতায় পরিণত হয় তার ইতিহাস সকলেই জানে।
বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক স্বাধীন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি নাগরিকের সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সকল অধিকার ভোগের অধিকার আছে। স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার। একটি দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমাদের কথা বলার অধিকার, স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা, মত প্রকাশের, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিজ ধর্ম পালন ইত্যাদি সব কিছুর অধিকার আছে। পলাশীর আম্রকাননে আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যটা অস্তমিত হয়েছিল। সেই দিনগুলোতে আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় আমাদের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এর পর ২০০ বছরের ইংরেজ শাসন ও ২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসনের নির্মমতায় আমাদের পূর্ব পুরুষরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে দিন কাটে। এই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এবং ৯ (নয়) মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়া গ্রামে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে গঠিত এই সরকার আমাদের স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক মহান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তির প্রভাব আছে। যে সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে তিনি নিজেকে আস্তে আস্তে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিলেন তারা হলেন বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-এ-বাংলা এ.কে.ফজলুল হক, মহাত্মা গান্ধী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও আরো অনেক ব্রিটিশ ভারতের নেতৃবৃন্দ। দেশ-বিদেশে অনেক মহান রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিকে বিখ্যাত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তিনি যে শিক্ষা নিয়েছেন সেই শিক্ষাকে তিনি এদেশের মানুষের মুক্তির অর্জনে কাজে লাগান। তিনি যখন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এবং যে কোনো কর্মসূচী দিতেন তার মূলে ছিল এদেশের সাধারণ জনগণ। কখনো কাউকে খুশী অথবা কারোর ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে তিনি কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেন নি। সর্বসাধারণের জন্যেই তিনি সারা জীবন ব্যয় করেন। অর্থাৎ এদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও সর্বসাধারণের অধিকার সংরক্ষণই উদ্দেশ্য। এই মহান নেতা পৃথিবীর যেখানেই গেছেন উপযুক্ত সম্মান আদায় ও অর্জন করেছেন। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমর্থন প্রকাশ করেন শিশুদের সাহচার্যে এসে। বিভিন্ন শিশু কিশোরদের মিলন মেলায় তিনি সব সময় শিশুসূলভ ব্যবহার করেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি যখন কোনো অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেতেন সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতও থাকতেন। তার কর্মব্যস্ত জীবনে শিশুদের মিলনামেলায় প্রশান্তি খুঁজে পেতেন। শিশুদের বিভিন্ন আনন্দ আয়োজনে শরীক হতে পেরে তিনি আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতেন। শিশুদের প্রতি তার আজন্ম মায়া মমতা-স্নেহ-ভালোবাসা তার রাজনৈতিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। তার সহজ-সরল বিশ্বাস এক সময় তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তারই সরলতার সুযোগ নিয়ে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে। ২০২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমাদের মুজিব বর্ষ ঘোষণা ও পালন শুধুমাত্র উদযাপনের উদ্দেশ্যে নয়। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সময়টা আমরা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি, কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি, কতটুকু অবদান শহীদ আত্মাদের দিতে পেরেছি, কতটুকু আমাদের বীরঙ্গনাকে সম্মান দিতে শিখেছি, কতটুকু প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে পেরেছি-তার বিচার বিশ্লেষণের বর্ষ।
স্বাধীন জাতি হিসেবে আমি ও আমরা এখন যা কিছু ভোগ করেছি তার বিপরীতে আমরা কতটুকু দিতে ও ছাড়তে প্রস্তুত তার পরিমাপ করার সময়ও এসেছে। এ মুজিব বর্ষে আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা সঠিক বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। আসলে আমরা কী ছেয়েছিলাম? আমরা কী পেয়েছি? এবং আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে কতটুকু রেখে যাচ্ছি।
স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা অর্জন এই পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাইতো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এই মহান পুরুষকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। জাতীয় দিবস পালনের লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের সন্তানদেরকে মুজিবীয় আদর্শে গড়ে তোলা। জাতির জনকের আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য একটি সুন্দর ও নিরাপদ আবাস ভূমি তৈরীর দায়িত্ব আমাদের।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ফজলুল হাজেরা ডিগ্রি কলেজ।