হারিয়ে গেছে হারানো ঐতিহ্য

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | সোমবার , ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

আমার বাবা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন হাটহাজারী মাদ্রাসা) এর প্রথম ব্যাচের হাফেজ এবং উক্ত মাদ্রাসার শূরা বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। আমরা ছোট বেলায় দেখতাম- আমাদের বাড়ীর সামনে বাবা একটি মক্তব চালাতেন, যেখানে গ্রামের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা এসে বাবার কাছ থেকে কোরআন শিক্ষা নিতেন। শুধু শিশুরাই নয়, অনেক যুবক-যুবতী, মধ্যবয়স্ক, এমনকি বয়স্ক ব্যক্তিরাও এসে বাবার কাছ থেকে কোরআনের ছবক নিতেন। বাড়ীর সামনে আম গাছের তলায় ঝিরঝির বাতাসে আল্লাহর কোরআনের আয়াতগুলো যেন গুঞ্জরিত হতো আর সেই সমুধুর কোরআনের শব্দ শুনে অনেক গ্রামবাসীর ঘুম ভেঙ্গে যেত। আমরা দেখতাম, গ্রামের অনেক বাড়িতে ফজরের নামাজের পর সব বয়সের নারী-পুরুষ-শিশু আল্লাহর কোরআনের আয়াতগুলো পাঠ করতেন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে। কিন্তু সেই হারানো ঐতিহ্যের ধারক-বাহক গ্রামীণ কোরানিক পাঠশালার চর্চা কিংবা পাঠ এখন নেই বললেই চলে। আমরা হারিয়ে ফেলেছি কিংবা ভুলে যেতে বসেছি সেই চিরাচরিত হারানো কোরআনের সূর, হারানো গ্রামীণ ঐতিহ্য। এখন আর গ্রামের বাড়ীতে শোনা যায় না আল-কোরআনের সুমধুর সুরের মূর্চ্ছনা। মুয়াজ্জিনের মধুর কন্ঠে যখন আজানের ধ্বনি শুনা যেত তখন গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে ছুটে যেত মসজিদ পানে। ফজরের জামাতে শরীক হতো কাতারবন্দি হয়ে। কিন্তু আফসোস, সেই পুরানো ধাঁচের সেই পুরানো আবেগ, সেই পুরানো বর্ণমালা এখন কি বেঁচে আছে? আমরা এখন হাতড়ে বেড়াই সকালের সেই গ্রামীণ শিশির ভেজা তরতাজা পরিবেশ। আমরা এখনো খুঁজে বেড়াই সকালের সূর্যের বর্ণময় মিতালি। কিন্তু হায় সেইতো হারিয়ে গেলো অমানিশার ঘোর আঁধারের ভিতর। গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় তখন ছিল অনেকগুলো কোরআনের পাঠশালা। যেখানে খুদে শিশুরা কোরআনের ছবক নিতেন মসজিদের ইমাম কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কাছ থেকে। সেই গ্রামীণ কোরআনিক পাঠশালার আদলে এখন গড়ে উঠেছে শত শত কিন্ডারগার্টেন। আর এটি হলো অন্যরকম সংস্করণ। এখানেও কোরআনের শিক্ষা দেওয়া হয় অত্যন্ত যত্ন সহকারে। কিন্তু যেটি প্রশ্ন থেকে যায়, এখন থেকে শিশুদের কোরআনের অর্থসহ না পড়ালে তাদের জিন্দেগীর মানসিক উৎকর্ষ সাধন আদৌ হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। অন্তত সরল অনুবাদটুকুন পড়ালে তারা কোরআনের ভাবার্থ বোঝার সক্ষমতা পেত। আর এটি হতো তাদের জন্য সাফল্যের সূতিকাগার। নিজের জীবনচরিত গঠনের ক্ষেত্রে কোরআন বোঝা ও জানার মধ্যে রয়েছে সাবলীল সম্পর্ক, সেতুবন্ধন। কচিকাঁচা শিশু-কিশোরদের এখন থেকেই কোরআন বুঝে পড়ার তাগিদ দেওয়া জরুরী বলে আমি মনে করি। আশির দশকের সময়েও পাড়ায় পাড়ায় গুঞ্জন শোনা যেত-কিসের সেই গুঞ্জন? এটিতো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশীবাণী- যেটি শুনলে হৃদয় হয়ে যায় বিগলিত, কেঁপে উঠে অন্তরাত্না আর প্রসারিত হয় হৃদয়ের চতুর্প্রকোষ্ট, ‘আসলে মোমেন তো হচ্ছে সেসব লোক, (যাদের) আল্লাহ তায়ালাকে যখন স্মরণ করানো হয় (তখন) তাদের হৃদয় কম্পিত হয় এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, উপরন্তু তারা তাদের মালিকের ওপর নির্ভর করে’- সূরা আল আনফাল-২। যে কোরআন দুনিয়া ও আখেরাতের একমাত্র অবলম্বন, একমাত্র অনুষঙ্গ সেটিকেই আমরা অযত্নে অবহেলায় উপেক্ষা করছি জিন্দেগীভর। এই কোরআন মানবজাতির জন্য পথের দিশা, সমস্যা সংকুল পৃথিবীর একমাত্র সমাধান। এই কোরআনকে আমরা যুগপৎ অবহেলা করছি যুগ যুগ ধরে। বছর বছর কাঠের তাকে সংরক্ষণ করছি এই কুরআনকে। এই কুরআন শুধু পঠিত হয় মিলাদে, পঠিত হয় ইছালে ছওয়াবে, পঠিত হয় মৃত মানুষদের বাড়িতে আর পঠিত হয় শুধু রমজান মাসে। অথচ এই কোরআন শুধুমাত্র কথনের জন্য আসেনি, আসেনি শুধুমাত্র জাতীয়/আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতার জন্যে। এই কোরআনের মর্যাদা এখনো বুঝিনি আমরা। এই কোরআনের সম্মান উপলব্ধি করিনি এখনও। আল-কোরআনকে আমরা এখনো বন্ধু বানাতে পারিনি নিজেদের জীবনে। বন্ধু বানিয়েছি বিজাতীয় সভ্যতাকে- যে সভ্যতার দাফন হচ্ছে এই আল্লাহর জমিনে বারবার। পৃথিবীর অন্য কোন তত্ত্ব, কোন মতবাদ, কোন আদর্শ, কোন ধর্মই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আর এটিই কোরআনুল করিমের পাতায় পাতায় বারবার তাগাদা দিচ্ছেন আল্লাহতায়ালা, ‘তারা কি আল্লাহর (দেয়া জীবন) ব্যবস্থার বদলে অন্য কোনো বিধানের সন্ধান করছে? অথচ আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তা ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, আল্লাহ তায়ালার সামনে আত্নসমর্পণ করে আছে এবং প্রত্যেককে তো (একদিন) তাঁর কাছেই ফিরিয়ে নেয়া হবে’- সূরা আল ইমরান- ৮৩।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রম আইন ও বিধিমালার আলোকে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা
পরবর্তী নিবন্ধবর্তমান পরিস্থিতি : উত্তরণ কোন্‌ পথে?