এক. ‘আলোকধারায় মিলি’ ৫৪তম পর্বটি সাজানো হয়েছিল ‘শ্রদ্ধায় স্মরণে কীর্তিমান’ শিরোনামে। এটি ফেসবুক লাইভ। কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তন শিক্ষার্থী কানাডা প্রবাসী বাচিক শিল্পী মুনিরা ইসলাম মিলির সঞ্চালনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছিলো কুণ্ডেশ্বরী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত দানবীর শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহয়ের কর্মমুখর কীর্তিময় জীবনের উপর। নেপথ্যে কাজ করেছেন শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের নাতনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জ্যেষ্ঠ কন্যা রাখি সিংহ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংগীতশিল্পী তপন চৌধুরী। কুণ্ডেশ্বরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্রী সোমা চৌধুরীর স্বামী হিসেবে তাঁর আরেকটি পরিচয়ও আমরা পাই। আরও যুক্ত ছিলেন প্রাক্তন ছাত্রী সাংবাদিক ডেইজি মউদুদ, শিক্ষিকা চন্দ্রা দেওয়ান, সংগীতশিল্পী ও প্রশিক্ষক রাখি সিংহ ও তার স্বামী প্রকৌশলী অনুপ সেন, শিক্ষিকা বিজয়া মুন্না, সংগীত শিল্পী কানাডা প্রবাসী ঝর্না আলম এবং আমি।
অনুপ সেনের আরেকটি পরিচয় তিনি প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ ও কল্যাণী সিংহের (বড় দিদিমণি) বড় জামাতা। রাখি সিংহের কণ্ঠে নজরুল সংগীত ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’ গানটি পরিবেশনের মাধ্যমে মূল পর্ব শুরু হয়। প্রাক্তন ছাত্রীরা কবিতা আবৃত্তি ও গান পরিবেশন করেন।
দুই. প্রাক্তন ছাত্রী সাংবাদিক ডেইজি মউদুদ তুলে ধরেন রাউজানে তাঁদের বাড়িতে বড় বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসা নূতন চন্দ্র সিংহকে স্বচক্ষে দেখার কথা। তাঁর বাবা কুণ্ডেশ্বরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। মন্টু মামা (প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ স্যারকে তিনি মামা বলে ডাকতেন) ভালো ফটোগ্রাফি করতেন। দানবীর শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের দেশের জন্য ত্যাগ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রসার, সমস্ত অর্থ দেশের মানুষের জন্য অকাতরে দান ও দেশপ্রেমের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা অবিস্মরণীয়। তাঁর পুত্র সেই ধারায় যুক্ত ছিলেন। প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহের কন্যা রাখি সিংহ জানান, ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর দাদু বার্মার আকিয়াব থেকে রাউজানে জন্মস্থানে ফিরে আসেন। ১৯৪৬ সালে সম্পূর্ণ নতুন উদ্যোমে আয়ুর্বেদ ওষুধের ব্যবসায় কর্মজীবন শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন কুণ্ডেশ্বরী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির ও মহাবিদ্যালয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন প্রাক্কালে তাঁর দাদু নূতন চন্দ্র সিংহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিবারকে আশ্রয় দেন। শিক্ষকরা চলে যাওয়ার সময় নূতন চন্দ্র সিংহকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। পরিবারের সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজ হাতে গড়া মন্দির ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না বলে দেন। পাক বাহিনী ও তাদের দালালের হাতে শহীদ মৃত্যুঞ্জয়ী বীর। যুদ্ধ শেষে কুণ্ডেশ্বরীর এক ধ্বংসস্তূপে ফিরে আসেন নূতন চন্দ্র সিংহের পরিবার। তাঁর মেজ ছেলে সত্য রঞ্জন সিংহ ও ছোট ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ দুই ভাই মিলে কুণ্ডেশ্বরী প্রতিষ্ঠানকে আরও সম্প্রসারিত করেন। এরই মধ্যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫০ বছর বয়সে সত্য রঞ্জন সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের বড় ভাই দুই বাংলার বিশেষ করে কলকাতার বরেণ্য লেখক কবি গবেষক চিত্ত রঞ্জন সিংহও মৃত্যুবরণ করেন।
তিন. রাখি সিংহ বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে নূতন চন্দ্র সিংহের জন্মবার্ষিকীতে একজন বরেণ্য ব্যক্তিকে স্বর্ণপদক ও শহীদ নূতন চন্দ্র স্মৃতি সংসদ থেকে চবির বাংলা বিভাগ থেকে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করা হতো। ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নেন প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ। মাত্র তিনমাসের ব্যবধানে বিদায় নেন তাঁর সহধর্মিণী কুণ্ডেশ্বরী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা কল্যাণী সিংহ।
লেখক : প্রাক্তন ছাত্রী, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির