ঘটনা ১
ট্যাম্পুতে সামনাসামনি বসে আছে একজন ভালো পরিপাটি পোশাক পরা মধ্যম বয়সের পুরুষ। দেখে মনে হচ্ছে বিবাহিত, বাচ্চা স্কুলে পড়ে। যেহেতু আমার মুখোমুখি এক নজরে তাকিয়ে আছে তো আছে। ব্যাপারটা উপেক্ষা করে কতক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে আছি, তারপরেও বুঝতে পারছি সে চোখ ঘুরেফিরে আমার দিকেই রাখছে। এবার তার কাজটাই করলাম আমি, এক নজরে তার দিকেই আমি তাকিয়ে আছি। এবার সে কতক্ষণ তাকায়, কতক্ষণ অন্যদিকে ফিরে। আর মেজাজ তখন চটে গিয়েছে। আর না পেরে তার সাথে কথা বলা শুরু করলাম,
আংকেল, বাসা কোথায়
-শান্তিবাগ।
আন্টি তো আছে, নিশ্চয় আপনার মেয়েও আছে একজন।
(লোকটি থতমত খেয়ে গেলো) হ্যাঁ আছে।
যাক বাবা, মেয়ে আছে তাহলে! মেয়ে নিশ্চয় বড়? কোন ক্লাসে পড়ে?
(পাংশুমুখে) ক্লাস ফাইভে।
(আমি হাসলাম) খুব ভালো। মেয়েকে দেখবেন।
আমাদের কথোপকথনে গাড়ির লোকজনেরাও তারদিকে তাকাচ্ছিলো। বেচারার চেহারাটা দেখে আমি তখন খুব মজা পাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করেন এরপর সে আর ভুল করেও আমার দিকে তাকায়নি। আগ্রাবাদ এঙেস রোডে গাড়ির প্রচণ্ড ঝাঁকুনির মুহূর্তেও যখন লোকজন সামনে-পিছনে-আশেপাশে দুলছিলো তখনও তার চোখের দৃষ্টি রাস্তার দিকে ছিলো,গাড়ির ভেতরের মানুষদের উপর পড়েনি। বুঝতে পারলাম হালকার উপর শিক্ষাটা খুব একটা খারাপ দিইনি। অন্যমেয়ের দিকে এভাবে তাকাতে ঝাপসা করে হলেও আজকের ঘটনা তার মনে পড়তে পারে।
ঘটনা ২
কোন গাড়ি পাচ্ছিনা, এদিকে অনেক মানুষ অপেক্ষা করছে গাড়ির জন্যে। একটা গাড়ি আসা মাত্রই সবাই হুড়মুড় করে এগিয়ে গেলো। ভিড়ের মধ্যে আমিও উঠছিলাম, পেছন থেকে একটা ছেলে একপ্রকার ইচ্ছে করেই গায়ের উপর উঠে আসার অবস্থা। তার হাত শরীরে লাগতেই পেছন ফিরে ঝাঁঝিয়ে বললাম ‘ঐ,কি সমস্যা? (মুখর ভেতর করে গালি দিলাম এবং সে আমার চেহারা দেখেই বুঝছে কোন গালিটা দিয়েছি)। এরপর বসলাম ভেতরে, ছেলেটি বন্ধুসহ ট্যাম্পুর দরজায় দাঁড়িয়ে। বন্ধুকে কি বলায় আমার দিকে দুজন তাকালো আর মুচকি-মুচকি হাসতেছে। এবার তাদের দিকে কটমট করে তাকাতে তারা অন্যপাশে তাকিয়ে হাসছিলো। তাদের হাসি দেখে আমিও তাদের দিকে দাঁতে দাঁত চেপে কটমট দৃষ্টি দিয়ে একনজরে তাকিয়ে আছিই তো আছি, চোখ মোটামুটি নামাচ্ছি না। এই অবস্থায় ট্যাম্পুর ভেতরের লোকগুলোও আমার দিকে তাকালো পরে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো তারা হাসতেসে। এরপর ট্যাম্পুর ভেতরের লোকদের বললাম, ‘দেখছেন ভাইয়াগুলো কত সুন্দর করে হাসে, সেই কখন থেকে হেসে চলেছে।’ এই কথাশুনে ছেলেগুলোর মুখ অপমানে সাথেসাথে পাংশু হলো আর হাসি মূহুর্তেই উবে গেলো। নীরব এই অপমানের কথা সে অন্তত কয়েকদিন মনে রাখবে,কিছু করার আগে একবার হলেও ভাববে।
ঘটনা ৩
ব্রিজের মধ্যে জ্যামে আটকে আছি। ব্রিজের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বেশ হেসে হেসে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গল্প করছে। তারা বড়জোর সেভেন এইটে পড়ে। ঐ মূহুর্তে আমাদের বাসের ড্রাইভার থেকে প্যাসেঞ্জার সকলের প্রতিজোড়া চোখ সেই দুজন ছেলেমেয়ের দিকে। কেউ কেউ ‘আহ প্রেম! এই ধরণের রসাত্মক কথাও বলছিলো।’ তাছাড়া ব্রিজের ফুটপাতের উপর দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছিলো তারাও তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই যাচ্ছিলো। এমনকী তাদেরকে ক্রস করে যাওয়ার পরও অনেকেই আবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। ভাবছি অন্যান্য গাড়ি থেকেও নিশ্চয় মানুষ তাদের দিকেই তাকাচ্ছে। যেন কোন গ্রহ থেকে আসা কোন প্রাণীকে প্রথমবার দেখছে। যেন তারা কোনদিন কোন মানুষের সাথে এভাবে গল্প করেনি, কিংবা কোন মেয়ের সাথে জীবনেও এভাবে কথা বলেনি। কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটোর কান্ডেই বেশি মজা পেয়েছি এবং শিক্ষা নিয়েছি। কে কোথায় কি করছে এতে তাদের কোন খেয়াল নেই। তারা তাদের মত হেসে হেসে গল্প করেই যাচ্ছে তো যাচ্ছে। এবং মাত্র সেভেন-এইটের বয়সীদের অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মাথা না ঘামানো, এসব খারাপ দৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত না করার মানসিকতা দেখে আসলেই খুব ভালো লেগেছে।
লিখতে বসলে স্কুল কলেজ থেকে এই পর্যন্ত এরকম অসংখ্য অসংখ্য ঘটনার কথা আমি লিখতে পারবো। শুধু আমি না রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে এরকম বিভিন্ন ঘটনার মুখোমুখি প্রতিদিনই হয় মেয়েরা। সবসময় রাস্তাঘাটে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে-করে চলাফেরা করতে-করতে ক্লান্তি চলে এসেছে মনে। দিনশেষে দুঃখ পাই তখন যখন আপনারা এই কথাগুলোকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে অযৌক্তিক বিতর্ক করেন। দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন একটা মেয়েকে আসলেই কতকিছু দেখতে হয়। আপনি পুরুষ হলে নিজে এসব থেকে দূরে তো থাকবেনই, সেইসাথে আপনার আশেপাশে কেউ যদি এমন করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন, তাকে সচেতন করুন। আর আপনি মেয়ে হলে অবশ্যই ভয়কে ঝেড়ে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। প্রতিবাদ না করে সহ্য করলে চিত্র পাল্টাবে না।












