করোনা পরিস্থিতিতে কলেজগুলোতে টেস্ট (নির্বাচনী) পরীক্ষা নেয়া হয়নি। বলতে গেলে নির্বাচনী পরীক্ষার বাধা ছাড়াই এইচএসসির চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল শিক্ষার্থীদের। এরপরও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী এবারের (২০২১ সালের) এইচএসসির ফরম পূরণ করেনি। সহজ সুযোগ পেয়েও ফরম পূরণ না করা এসব শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষক ও শিক্ষাবোর্ড সংশ্ল্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে এবছর নির্বাচনী পরীক্ষার আয়োজন ছিল না। সে সুবাদে নিবন্ধনকৃত শতভাগ শিক্ষার্থীর ফরম পূরণের কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেনি। বিশেষ করে করোনায় পরিবারের আর্থিক সঙ্কটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করতে পারেনি বলে মনে করছেন নগরীর ওমরগনি এমইএস কলেজের অধ্যক্ষ আ ন ম সরোয়ার আলম। এছাড়া ছাত্রীদের বিয়ে হয়ে যাওয়া এবং গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার পর কিছু শিক্ষার্থীর আর ফিরে না আসার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে বলে জানান তিনি। শিক্ষাবোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার (২০২১ সালের) যারা এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। ওই সময় মোট ১ লাখ ৯ হাজার ১৬৮ শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন হয় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে। রেজিস্ট্রেশনভুক্ত এসব শিক্ষার্থীর এবার এইচএসসির ফরম পূরণের কথা। তবে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মাঝে গতকাল পর্যন্ত এইচএসসির ফরম পূরণ করেছে ৮৯ হাজার ৩৩৯ জন। আর অনিয়মিত ১০ হাজার ৯০৭ জন এবং প্রাইভেট ও মানোন্নয়ন পরীক্ষার্থীসহ মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ চারশর সামান্য বেশি। হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করেও ১৯ হাজার ৮২৯ জন (প্রায় ২০ হাজার) নিয়মিত শিক্ষার্থী এইচএসসির ফরম পূরণ করেনি। ফরম পূরণ না করা এসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে বলে ধারণা শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। শিক্ষাবোর্ডের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানবিকের শিক্ষার্থীদের মাঝেই ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি। কেবল মানবিক বিভাগের সাড়ে ১২ হাজারের বেশি (১২ হাজার ৬৪৬) শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেনি। ব্যবসায় বিভাগে ফরম পূরণ না করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬ হাজার ৩৬৯। আর বিজ্ঞান বিভাগে এ সংখ্যা ৮১৪ জন।
শিক্ষাবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বিজ্ঞান বিভাগে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৭৩৭ জন। এর মাঝে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছে ১৮ হাজার ৯২৩ জন। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ৩৮ হাজার ৬৮১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ফরম পূরণ করেছে ৩২ হাজার ৩১২ জন। আর মানবিকের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ৫০ হাজার ৭৫০ জনের মধ্যে ৩৮ হাজার ১০৪ জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ সম্পন্ন করেছে।
প্রথম দফায় অনলাইনে ফরম পূরণের সময়সীমা শেষ হলে দ্বিতীয় দফায় সময়সীমা বাড়ানো হয় জানিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, দ্বিতীয় দফায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফরম পূরণের সময় নির্ধারিত ছিল। যদিও এইচএসসির ফরম পূরণে আরো এক দফা সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। সেটি হলে আরো কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী ফরম পূরণের আওতায় চলে আসবে বলে মনে করেন তিনি। প্রতি বছরই ড্রপ আউট হয়ে থাকে জানিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, তবে এবার যেহেতু নির্বাচনী পরীক্ষা ছিল না। ড্রপ আউট কম হওয়ার কথা ছিল।
ওমরগনি এমইএস কলেজে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২১০০ জন। তবে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত এসব শিক্ষার্থীর মাঝে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে ১৭০০ জন। হিসেবে প্রায় চারশ জন শিক্ষার্থী এইচএসসির ফরম পূরণ করেনি। করোনা সংক্রমণের কারণে এবার নির্বাচনী পরীক্ষা নেয়া হয়নি জানিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ আ ন ম সরোয়ার আলম আজাদীকে বলেন, নির্বাচনী পরীক্ষা না নেয়ায় রেজিস্ট্রেশনভুক্ত শতভাগ শিক্ষার্থীর ফরম পূরণের কথা। কিন্তু এত সহজ সুযোগ থাকার পরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেনি। করোনায় অনেক পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। তাদের জন্য ফরম পূরণের টাকা পরিশোধ করাটাও খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। আর কিছু শিক্ষার্থী গ্রামের বাড়ি চলে যায়। সেখান থেকে আর ফিরে আসেনি। এসব কারণে এবার ড্রপ আউটের সংখ্যাটা বেড়েছে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
সাতকানিয়া আদর্শ মহিলা কলেজে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬২৭ জন। কিন্তু এবার এইচএসসির চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ সম্পন্ন করেছে ৪৩৬ জন। হিসেবে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত নিয়মিত শিক্ষার্থীর মাঝে প্রায় দুইশ শিক্ষার্থী এবার ফরম পূরণ করেনি। করোনাকালে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছেন বলে জানান কলেজ অধ্যক্ষ শিব শংকর শীল। তাছাড়া পরিবারের আর্থিক সঙ্কটের কারণেও অনেকে ফরম পূরণ করেনি বলে মনে করেন এই কলেজ অধ্যক্ষ।
সবমিলিয়ে ফরম পূরণের ক্ষেত্রেও করোনা প্রভাব ফেলেছে জানিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর জাহেদুল হক বলছেন, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি (বেতন) দিতে না পেরেও অনেকে হয়তো ফরম পূরণ করতে পারেনি। করোনা কালে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী ওই সময় নিয়মিত টিউশন ফি পরিশোধ করেনি। ফরম পূরণের সময় বকেয়া টিউশন ফিসহ ফি’র অংকটা হয়তো বড় হয়ে যায়। কিন্তু করোনার কারণে সব পরিবার এ টাকা হয়তো পরিশোধ করতে পারেনি। যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করতে পারেনি বলে আমাদের ধারণা। এছাড়া ছাত্রীদের বিয়ে হয়ে যাওয়াও একটা কারণ হতে পারে।