মুক্তিযোদ্ধাদের শহীদ বেদীর উপর সিআরবিতে হাসপাতাল করার চক্রান্ত শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও প্রতিরোধ করা হবে। এই হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল না করা পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে আয়োজিত এক প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের আহ্বানে সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের অংশগ্রহণে প্রতিবাদী এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান এই সিআরবি। চট্টগ্রামের মানুষ এখানে বেসরকারি হাসপাতাল চায় না। এ আন্দোলনে শুধু চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ নয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও সামিল হয়েছেন। সবাই বলেছেন সিআরবি রক্ষা করতে হবে চট্টগ্রামের স্বার্থে। যতদিন হাসপাতাল নির্মাণের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হবে ততদিন ঐক্যবদ্ধভাবে চট্টগ্রামের স্বার্থে আমরা সবাই এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাব।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, এই সিআরবি আমাদের শৈশবের স্মৃতি ধন্য স্থান। শুধু গাছ নয় আমরা সিআরবির পুরো জায়গাটাই রক্ষা করতে চাই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য সিআরবি। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে বহু মানুষ শহীদ হয়েছেন এখানে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ২৪ ধারায় বলা আছে, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান রক্ষা করতে হবে। তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এখানে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছে। সিআরবি ভবন ব্রিটিশ স্থাপত্যের শেষ কয়েকটির একটি। রেলের যে হাসপাতাল সেটাকে পুনরুজ্জীবিত করে ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে। কোনো বাণিজ্যিক হাসপাতাল নয়। পিপিপি মানে জনগণের টাকা, জনগণের টাকায় ধনীদের হাসপাতাল চাই না। এ সঙ্গে ডিসি হিল রক্ষার আন্দোলনও আমরা চালিয়ে যাব। সেখানে যাতে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ থাকে।
পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ এবং খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, জনগণের টাকাই সরকারের টাকা। রেলের জমি বলে কিছু নেই, সব জনগণের সম্পত্তি। সরকারি কোনো জায়গায় কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হতে পারবে না। সিআরবি বা গোয়ালপাড়া নয় এখানে বেসরকারি হাসপাতাল হতে দেয়া যাবে না। বেসরকারি হাসপাতালের চরিত্র করোনাকালে দেখেছি আমরা। চট্টগ্রামে একটা ক্যান্সার, অর্থপেডিক, সরকারি শিশু হাসপাতাল বা হৃদরোগের হাসপাতাল নেই। সরকারি হাসপাতাল করার উদ্যোগ নেন। এই প্রকল্প বাতিল না হলে আমরণ অনশন করব সবাইকে নিয়ে। সাথে সাথে আমাদের ডিসি হিল রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান, গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, রেলওয়ে বলছে এখানে হাসপাতাল হলে গাছ কাটা পড়বে না। গুণে দেখেছি তিনশ গাছ আছে শতবর্ষী গাছসহ। যা বলা হচ্ছে, গাছ কাটা হবে না, তা সঠিক নয়। হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হলে এ এলাকা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে যদি সঠিক তথ্য জানানো যায় তাহলে তিনি এ প্রকল্প বাতিল করবেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুচ বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বিএনপি নেতাদের গ্রুপ এখানে হাসপাতাল করতে চায়। এখানে ৯ জন শহীদের কবর আছে। শহীদের সমাধির উপর রক্তাক্ত স্বাধীনতার ইতিহাস ম্লান করতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সব মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আজ রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই। মহিউদ্দিন চৌধুরী থাকলে কারো সাহস হত না এখানে হাসপাতাল করার। চট্টগ্রামে কোনো পার্ক নেই। চট্টগ্রামের হৃৎপিন্ড ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ধনীদের প্রাইভেট হাসপাতাল আমরা চাই না। মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধির উপর হাসপাতাল চাই না। প্রধানমন্ত্রী আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। বিনীত অনুরোধ প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত স্থানটি রক্ষা করুন।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, সিআরবি এলাকা সিডিএ কর্তৃক হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে হাসপাতাল হতে পারে না। রেল মন্ত্রণালয় তারপরও অনেক কিছু গোপন করে হাসপাতাল করতে চেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে অনেক কিছু জানানো হয়নি। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যদি সিআরবিতে চট্টগ্রামের মানুষ হাসপাতাল না চায় তাহলে কোনো হাসপাতাল হবে না। মানুষের চেতনা, নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষা করে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। রেলমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা জানাই। এ বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। তা মানুষের মনে আঘাত দিয়েছে। সিআরবিতে হাসপাতালের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে আগের মত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
নগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, গোয়ালপাড়া কোনো সরকারি জায়গা না। ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা। যে জমি অ্যাকোয়ার করা হয়েছে সেটা হাসপাতাল কলোনি। যার আসল নাম শহীদ আবদুর রব কলোনি। বেশিরভাগ স্টাফদের বিদায় করে দেয়া হয়েছে কলোনি থেকে। রেলের বক্তব্যের কোথাও নেই শহীদ আবদুর রব কলোনি অ্যাকোয়ার করে হাসপাতাল হচ্ছে। তাই কৌশলে গোয়ালপাড়া বলছেন। চ্যালেঞ্জ করছি এটা গোয়ালপাড়া নয়। শহীদ আবদুর রবের বাবার বাসা এখানে। সে বাসা থেকে তিনি যুদ্ধে যান। যুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিতে এখানে বাণিজ্যিক হাসপাতাল হতে পারে না। হাসপাতাল হলে মালিপাড়া, গোয়ালপাড়া, এনায়েত বাজার, বাটালি রোডে মেডিকেল বর্জ্যের ভাগাড় হবে। তা হতে দেয়া হবে না।
শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু বলেন, কাউকে ভুল বুঝাবেন না এটা গোয়ালপাড়া বলে। মেয়র বলেছেন জমি লাগলে তিনি দেবেন। জনগণের কাতারে আসুন সবাই। দেড় কোটি টাকায় ডিসি হিলে মঞ্চ করার পর আজ সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ। শহীদ মিনার সরাতে চান। সিআরবি নিতে চান। কি বুঝাতে চাইছেন? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান আপনি ঘোষণা দিন হাসপাতাল সরে যাবে। হাসপাতাল হোক অন্য কোথাও।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, সমবেতরা সকলেই চট্টগ্রামের স্বার্থে হাসপাতাল প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। এখানে যারা এসেছেন সবাই চট্টগ্রামকে ভালোবাসেন। আশা করি এই হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল করা হবে।
সিপিবি নেতা নূরুচ্ছফা ভুঁইয়া বলেন, রেল কিভাবে এখানে প্রকল্প নিল সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। এখন সবাই বলছেন প্রধানমন্ত্রী জানেন। সবাই উনার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রীকে যদি সবকিছু দেখতে হয় তাহলে বাকিরা কি করেন। সিআরবিতে ধনীদের জন্য হাসপাতাল বানিয়ে প্রকৃতি ধ্বংসের প্রক্রিয়া আমরা চাই না।
পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, সিআরবিতে কোনোভাবে এ হাসপাতাল চাই না। প্রতিবাদকারীরা চট্টগ্রামকে রক্ষার জন্য এসেছেন। আশা করি সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে সরকারের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন শ্যামল বলেন, কারা এ হাসপাতালের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত তা চট্টগ্রামের মানুষ জানে। আপনারা কারা? ইউনাইটেড বেনিয়া গ্রুপ। হাইব্রিডদের কথায় মানুষের স্বার্থ নষ্ট করবেন না। ইউনাইটেডের সাথে বিএনপির নেতারা জড়িত, হাইব্রিড আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়রা জড়িত। এই চট্টগ্রাম বন্দরও বেনিয়াদের দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল তা চট্টগ্রামের মানুষ ঠেকিয়ে দিয়েছে। সিআরবিও আমরা বেনিয়াদের হাতে দিতে দিব না।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদ হাসান বলেন, এ হাসপাতাল বেনিয়া স্বার্থে করা হবে। জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে না। বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ মানুষ কোনো সেবা পাবে না। আমরা সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল চাই না। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বলয় সিআরবিকে অক্ষত রাখতে হবে।
নাগরিক সমাজের পক্ষে বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী বলেন, আমরা সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল চাই না। সিআরবি চট্টগ্রামের ফুসফুস। প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের সুরক্ষা করেই উন্নয়ন প্রকল্প নেন। প্রকৃত তথ্য জানতে পারলে আশা করি তিনি এ প্রকল্প বাতিল করবেন।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরীর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আলীউর রহমান, সাংবাদিক আসিফ সিরাজ, সাংবাদিক ঋত্বিক নয়ন, নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আ ফ ম সাইফুদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এনি সেন প্রমুখ। প্রতিবাদী আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তি শিল্পী মিলি চৌধুরী ও তৈয়বা জহির আরশি।
সংহতি জানান চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, কবি সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল, সাংস্কৃতিক সংগঠক শীলা দাশগুপ্তা, ন্যাপ নেতা মিঠুল দাশগুপ্ত, নগর কৃষক লীগ নেতা হুমায়ন কবির মাসুদ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত নবী খোকা, সাংবাদিক মহররম হোসেন, পার্থ প্রতিম বিশ্বাস, আমিন মুন্না, রাহুল দত্ত, টিটু দত্ত, মিনহাজুল ইসলাম, বিনয় ভৌমিক প্রমুখ।
সংহতি জানায় আমরা কৃষকের সন্তান পরিষদ, প্রমা, বোধন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ মানবাধিকার ও পরিবেশ ফাউন্ডেশন, আমরা চট্টগ্রামবাসী, স্মাইল বাংলাদেশ, মানবিক সংগঠন মুসাফির, বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন দক্ষিণ জেলা, ভয়েস অব চট্টগ্রাম, জাগো চট্টগ্রাম বাঁচাও সিআরবি, অদিতি সঙ্গীত নিকেতন।