ঠিক কবে কখন কে সাহিত্যের এই ছন্দিত নন্দিত গভীর ভাব কে ‘কবিতা’ নামকরণ করলেন সেই তথ্য আমার অজানিত। তো যেভাবেই হোক সে আজ ‘কবিতা’ নামে খ্যাত। বিষয়টি আদতে গভীর একটি ঘোরের জগত যেখানে প্রতিটা শব্দ প্রতিটা লাইন পড়ুয়াদের মনে ঘোর তৈরি করতে পারে। আমি অন্ততঃ যখন থেকে কবিতা পড়ুয়া তখন থেকেই কবিতার এই ঘোরের মাঝারে ডুবে যাই। যার মানে হঠাৎ একটি শব্দ একটি লাইন একটি ছবির চিত্রকল্প মন কে তাড়িত করে, মন কে চালিত করে এক পর্যায়ে লিখতে বাধ্য করে। এমন ঘোর কে আমি নমস্য কবিতার পটভূমি ভাবি। এমনই এক মুহূর্তে সেই পনের-ষোল-র উড্ডীন বয়সে পড়েছিলাম প্রথম জীবনানন্দ দাস এর ‘বনলতা সেন’। তো কত শতবার পড়েছি নাওয়া-খাওয়া ভুলে তার হিসেব রাখার প্রশ্ন আসে না, সারাবেলা মাথায়-মননে দুই লাইন ঘুরছে-
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ আর ‘এতদিন কোথায় ছিলেন? আমারে শুধিয়েছে পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’ এই লাইন দুটির সে যে কী অপার গভীরতা সে যে কী চিত্রকল্পময় আর কোনও শব্দে তার ব্যাখ্যা অসম্ভব। সন্ধের গভীর নির্জনতা ঘিরে ধরলে আমার তখন নিজেকে বনলতা সেন মনে হতো! তেমন দিনের এক পর্যায়ে বাবার বাড়ির বাগানের ঝোপের লতাগুল্মে ছোট্ট একটা নীলফুল ফুটন্ত দেখেছিলাম জানি না নাম- তো খেরোখাতায় লিখলাম-
‘আগাছার ঝোপে ছোট্ট নীলফুল
আমারই বাগানে জন্ম
অথচ আমার কৃতিত্ব নয়-
ওগো ও ছোট্ট নীলফুল
বলো তুমি কী আমার?’
আর যখন “আমার স্বপ্ন” নামের ঝকঝকে সুন্দর কবিতার বই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর প্রথম কবিতার বই উপহার পেয়েছিলাম বড়চাচার (কবি বেলাল চৌধুরী) কাছে, বইটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর প্রিয় তিন কবি বন্ধু কে- কবি বেলাল চৌধুরী, সুচরিত মিত্র, দেবারতি সেন কে। আর কবির নিজের হাতে লিখিত বইটি বড়চাচা আমাকে নির্দ্বিধায় দিয়ে দেন। আমি তো সুবিস্ময়ে রোমাঞ্চিত। আর যখন পড়তে থাকি-
“বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?
এই দিকশূণ্য ওড়াউড়ি এ যেন শিল্পের রূপ ..
বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?”
এমন অবিশ্বাস্য প্রায় শিল্পিত দিকশূন্য ওড়াউড়ি তুলো বীজের আমিও যেন তারই সঙ্গে ধাই.. আজও ঠিকই মনে পড়ে সম্ভবত অর্ধমাস আমি শুধু-
“বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?”
আর –
“এই দিকশূন্য ওড়াউড়ি এ যেন শিল্পের রূপ”
এমন ওড়াউড়ির পাল্লায় পড়ে নিজের মধ্যে নিজে নেই তেমনই ঘোরের ভিতর ঘুরে বেড়িয়েছি বহু দিবস-রজনী।
এগুলো অল্প বয়সের ঘোর। এখন পঁয়ষট্টির প্রবীণ বয়সে ভাবের ঘোর আগের মতোন দীর্ঘ হয় না বটে আবার স্বল্পায়ুও বলা যায় না ততটা। এখন জীবনবোধ তার বাস্তব অবস্থানের জানান দিয়েই কবিতায় আসে সমধিক জোরালো গভীরতায়। আর তেমন গভীর বোধসম্পন্ন না হলে কবিতাপাঠে মন যায় না তেমন করে। মোদ্দাকথাটা এই কবিতা মানেই কী এক গভীর শব্দময় ভুবন সেইখানে স্বপ্ন ও ভাব জড়াজড়ি করে ওড়ে ও ওড়ায় পড়ুয়ার কল্পলোকের ভাব। কবিতার ভাবনায় খুব গভীরতম একটা সুবসতি বাস করে বাস্তবে যার অস্তিত্ব ক্ষীণ হলেও ছায়াময় ও মায়াময় উপস্থিতি কেবল কবি ও পাঠক টের পায়। নিজের সমকালীন কবিতার কয়েকটি লাইন পাঠকদের জন্য-
‘ও আমার গান যেখানে হৃদয় নত শোনো মুগ্ধতার গান অন্তর্গত।
ও আমার গান যাও পাতায় থাকো মনভাঙা সব চাপেও হৃদয়জয়ী গন্ধে ডাকো।’