সারাদেশের ন্যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়ও ভূমিহীনদের মাঝে খাস জায়গায় বিনামূল্যে ঘর দেওয়ার কাজ চলমান রয়েছে। প্রথম দফায় উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ভূমিহীন, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা, ভিক্ষুকসহ বাড়ি নেই এমন বিভিন্ন ক্যাটাগরির দরিদ্রদের কাছে ৮০টি ঘর হস্তান্তর করেছে উপজেলা প্রশাসন। দ্বিতীয় দফায়ও কয়েকশত ভূমিহীনকে খাস জায়গায় বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের আলোচিত উচিতার বিলে খাস জায়গায় বাড়ি তৈরি করার ক্ষেত্রে বারবার বাধার সম্মুখীন হয়ে আসছিল উপজেলা প্রশাসন। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের এক নম্বর খাস খতিয়ানের উচিতার বিল মৌজার বিএস ৪০৪ দাগের বিপুল পরিমাণ জায়গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী দখলে রাখায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি গত ২৯ এপ্রিল উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নির্দেশে চিরিঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার, ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারসহ একদল কর্মচারী ও শ্রমিকেরা গিয়ে সংরক্ষিত বনের ভেতর অবৈধ ইটভাটা লাগোয়া প্রায় সাড়ে সাত একর খাস জায়গা পরিচিহ্নিত করে চারিদিকে লাল পতাকা উঁচিয়ে দেওয়াসহ সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়।
ভূমি কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ওইদিন (২৯ এপ্রিল) ভূমি অফিস সংশ্লিষ্টরা চলে আসার পর সেই খাস জায়গার লাল পতাকা এবং সাইনবোর্ড গুঁড়িয়ে দেয় গিয়াস উদ্দিনের লোকজন। এরপর সেই জায়গা ইটভাটার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, দখলে নেওয়া সেই খাস জায়গার টিলা শ্রেণীর পাহাড়ে এক্সেভেটর দিয়ে পুকুর খননেরও কাজ শুরু করেন আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস। সরজমিন এই পরিস্থিতি গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চিরিঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা (তহসিলদার) সলিম উল্লাহ প্রত্যক্ষ করে আসার পর সেখানে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তানভীর হোসেন। এ সময় সাথে ছিলেন পুলিশসহ ভূমি সংশ্লিষ্ট অসংখ্য কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং নিয়োজিত শ্রমিকেরা।
আদালত সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিনের দখলে নেওয়া খাস জায়গার টিলা শ্রেণীর পাহাড়ে এক্সেভেটর দিয়ে পুকুর খনন করা হচ্ছিল। অভিযানের সময় পাহাড় কাটায় ব্যবহৃত এক্সেভেটরটি জব্দ করা হয়। ইটভাটার অভ্যন্তরে দখলে রাখা প্রায় সাড়ে সাত একর খাস জায়গা উদ্ধারের পর ফের লাল পতাকা উঁচিয়ে সাইনবোর্ডও সাঁটিয়ে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় জব্দকৃত এক্সেভেটরটি অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন এবং ইউনিয়ন পরিষদের সচিবকে তাদের নিজ খরচে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত নির্দেশ দেন।
সূত্র আরো জানায়, একই মৌজার এক নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত বিএস ১৬৮ দাগের ৩০ একর ৪৭ শতাংশ থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গার দখল সম্প্রতি বিক্রি করা হয়। সেই জায়গায় দখলদারেরা রাতারাতি কয়েকটি স্থায়ী স্থাপনাও তৈরি করে। সেই অবৈধ স্থাপনাও গতকাল বৃহস্পতিবার গুঁড়িয়ে দিয়ে খাস জমি নিয়ন্ত্রণে নেয় উপজেলা প্রশাসন।
এক নম্বর খাস খতিয়ানের ১৬৮ দাগের খাস জায়গা বিক্রি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চিরিঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা (তহসিলদার) সলিম উল্লাহ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে আরো শতাধিক ভূমিহীন পরিবারের জন্য বিনামূল্যে বাড়ি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন এই দাগের বিপুল পরিমাণ খাস জায়গা দখলে নেন এবং সাড়ে ৮ লক্ষ টাকায় ওই খাস জায়গার দখল বিক্রি করে দিলে ক্রেতারা সে জায়গার দখল আরো কয়েকজনের কাছে বিক্রি করেন। এবং সর্বশেষ ক্রেতাপক্ষ সেখানে স্থায়ী স্থাপনাও তৈরি করেছে। অভিযানে অবৈধ স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে উদ্ধার করা হয় দখলে রাখা প্রায় ৬০ শতাংশ খাস জায়গা।’
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তানভীর হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীনদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার জন্য খাস জায়গা পরিচিহ্নিত করে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের উচিতার বিল মৌজায় লাল পতাকা এবং সাইনবোর্ড সাঁটানো হয় কিছুদিন আগে। কিন্তু সেই জায়গা আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী দখলে নিয়ে নাল ও টিলা শ্রেণীর পাহাড় সাবাড় কেটে সেখানে পুকুর খনন করছিলেন। অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালানো হয়। এ সময় পাহাড় কাটায় ব্যবহৃত একটি এক্সেভেটর জব্দ করাসহ ইটভাটার নিয়ন্ত্রণ থেকে সাড়ে সাত একর খাস জায়গা পুনরুদ্ধার করে চারিদিকে ফের লাল পতাকা ও সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়েছে।’
এসি ল্যান্ড তানভীর হোসেন আরো বলেন, ‘অভিযানের সময় জব্দকৃত এক্সেভেটরটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের আদেশ মোতাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আগামী শনিবারের মধ্যে (২৯ মে) পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এবং সচিবকে পত্র দেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকভুক্ত প্রকল্প খাস জায়গায় ভূমিহীনদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করতে গিয়ে বারবার বাধা পাচ্ছিলাম ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে দখল হওয়া সরকারি জায়গা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এখন সেখানে ভূমিহীনদের জন্য বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করা হবে।’
ইউএনও আরো বলেন, সরকারি খাস খতিয়ানের জায়গা দখলে নিয়ে টিলা শ্রেণীর পাহাড় কাটাসহ জমির শ্রেণী পরিবর্তনের অভিযোগে পরিবেশ আইনেও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি কুচক্রী মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।’