করোনা আক্রান্তদের মাঝে যেসব রোগীর শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি ফুসফুস ৩০ শতাংশের বেশি সংক্রমিত, সেসব জটিল রোগীর জরুরি চিকিৎসা হিসেবে একটি ইনজেকশন দিতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। রেমডেসিভির নামের ওই ইনজেকশনের ৬টি ভায়াল দেওয়া হয় রোগীকে। চিকিৎসকদের কেউ বলছেন, করোনা রোগীর ফুসফুসের ৩০ শতাংশের বেশি সংক্রমণ ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে এই ইনজেকশনটি দেওয়া হয়। আবার কেউ বলছেন, ফুসফুস সংক্রমিত হওয়া ছাড়াও শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য জটিলতার কারণে রোগীর শারীরিক অবস্থা যদি জটিল বা খারাপ হয়, সেক্ষেত্রেও এই ইনজেকশন দেওয়া হয়। তবে জটিল রোগীর ক্ষেত্রে এই ইনজেকশনটি উপসর্গ দেখা দেওয়ার ৭ দিনের মধ্যে দেওয়াটাই উত্তম।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্য সরকারিভাবে বিনামূল্যে এই ইনজেকশন সরবরাহ করা হয়। এই ৬ ভায়াল ইনজেকশন বাজার থেকে কিনতে গেলে ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ পড়ে। সে হিসেবে প্রতি ভায়ালের দাম পড়ে ৩ হাজার টাকার বেশি। তবে ডোজ হিসেবে ৬ ভায়াল ইনজেকশন দিতে হয় রোগীকে। সরকারিভাবে না পেলে বাজার থেকে এই ইনজেকশন কেনা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে অস্বচ্ছল বা গরিব রোগীদের জন্য এটি খুব কঠিন বলে জানান চিকিৎসকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বেশ কিছুদিন ধরে করোনা আক্রান্তদের মাঝে জটিল রোগীদের বিনামূল্যের এই ইনজেকশন সরবরাহ দিতে পারছে না চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলো। যার কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের বাজার থেকেই এই ইনজেকশন কিনে নিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে অস্বচ্ছল ও গরিব রোগীরা বিপাকে পড়েছেন বেশি। ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করে এই ইনজেকশন কেনার সক্ষমতা এসব রোগীর নেই।
চিকিৎসকরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা বেশিরভাগ রোগী আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ও গরিব পরিবারের। আর্থিক সক্ষমতা থাকা বেশিরভাগ রোগী সরকারি হাসপাতালের পরিবর্তে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাই এই ইনজেকশনের সরকারি সরবরাহ না থাকায় সরকারি হাসপাতালের বেশিরভাগ রোগীই বিপাকে পড়েছেন।
মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সরকারিভাবে সরবরাহ না পাওয়ায় রোগীদের এই ইনজেকশন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর। তিনি আজাদীকে বলেন, ইনজেকশনটি তুলনামূলক একটু দামি। সবার পক্ষে দোকান থেকে কেনা সম্ভব নয়। আমাদের স্টক (মজুদ) যতদিন ছিল আমরা রোগীদের দিয়েছি। স্টক শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবারো চাহিদা দিয়েছি। কিন্তু চাহিদাপত্র পাঠালেও বেশ কিছুদিন ধরে এই ইনজেকশন পাচ্ছি না। সরকারিভাবে সরবরাহ না থাকায় রোগীদেরও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা ঢাকায় বারবার তাগাদা দিচ্ছি।
একই তথ্য জানালেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ও মেডিসিনের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব মাসুম। তিনি বলেন, আক্রান্তদের মাঝে যাদের ফুসফুস ৩০ শতাংশের বেশি সংক্রমিত হিসেবে ধরা পড়ে, অর্থাৎ শারীরিক অবস্থা কিছুটা জটিল বা খারাপের দিকে, এমন রোগীকে আমরা এই ইনজেকশনটা দিয়ে থাকি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মাঝে ১০ শতাংশের মতো রোগীর এই ইনজেকশন প্রয়োজন পড়ে। তবে এটা ঠিক, আর্থিকভাবে তুলনামূলক অস্বচ্ছল রোগীরাই বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। তাই একটু দামি এই ইনজেকশন দোকান থেকে কিনে চিকিৎসা নেওয়াটা সবার পক্ষে সহজ নয়। কিন্তু আমরাও নিরুপায়। আমরা ঢাকায় চাহিদা দিয়েছি। ১২ হাজার ভায়ালের চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। সরকারিভাবে সরবরাহ পেলে রোগীরাও আবার বিনামূল্যে পাবেন।
চলতি বছরের শুরু থেকে এই ইনজেকশনের সরবরাহ নেই ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতালে। ফলে ৩ মাসের বেশি সময় ধরে রোগীকে ইনজেকশনটি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ তথ্য নিশ্চিত করে বিআইটিআইডি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. মামুনুর রশীদ আজাদীকে বলেন, জাতীয় পরামর্শক কমিটি কর্তৃক তৈরি করা করোনা চিকিৎসায় ন্যাশনাল গাইডলাইনে এই ইনজেকশনটি রিকমেন্ড করা হয়েছে। যার কারণে ইনজেকশনটি সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের দেওয়া হয়ে থাকে। যদিও সব রোগীকে এই ইনজেকশন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শ্বাসকষ্টসহ যেসব রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ বা জটিল, সে ধরনের রোগীকে এই ইনজেকশন দেওয়ার পরামর্শ রয়েছে। অবশ্য, এক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগীর উপসর্গ দেখা দেওয়ার ৭ দিনের মধ্যে এই ইনজেকশন দেওয়াটা উত্তম।
এদিকে, রেমডেসিভির ইনজেকশনের সংকট থাকলেও করোনা রোগীর নাভিতে পুশ করার যে ইনজেকশন (এনোক্সাপেরিন জাতীয়) সেটির সরবরাহ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, হাসপাতালে বর্তমানে এই ইনজেকশনের সরবরাহ রয়েছে এবং যেসব রোগীর দরকার পড়ছে তাদের বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। নাভিতে পুশ করার এই ইনজেকশনটিও ন্যাশনাল গাইডলাইনে রিকমেন্ড করা বলে জানিয়েছেন বিআইটিআইডি হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. মামুনুর রশীদ। এই ইনজেকশনটি রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে বাধা দেয়।
উল্লেখ্য, গতকাল চমেক হাসপাতালের করোনা ব্লকে ১৮০টি শয্যায় ১৫৬ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ১৪০ শয্যার মধ্যে ৮৫ জন এবং ৩২ শয্যার বিআইটিআইডি হাসপাতালে ২৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।