শেয়ার হস্তান্তরে জালিয়াতি, নির্বাচনের আগে তিন মাসে ২০০ নতুন সদস্য!

চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি ।। অভিযোগের তীর সম্পাদক শাহজাহান ও তার ভাই সাজ্জাদের দিকে

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৩ মার্চ, ২০২১ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী সমবায় প্রতিষ্ঠান দ্য চিটাগাং কো অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের ৯০৪ থেকে ৯০৮ নম্বর পর্যন্ত ৫টি শেয়ারের মালিক ছিলেন মোহাম্মদ রাশেদ। সোসাইটির প্রবীণ এই সদস্য কয়েক বছর আগে মারা যান। ‘নিয়মানুযায়ী মৃত সদস্যের ডেথ সার্টিফিকেট, ওয়ারিশান সার্টিফিকেট এবং শেয়ার হস্তান্তরের জন্য আবেদনপত্র সোসাইটি কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। এরপর ‘যাচাই বাছাই সাব কমিটি’ পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ব্যবস্থাপনা কমিটির নিকট সুপারিশ করবে। ব্যবস্থাপনা কমিটি উক্ত সুপারিশে সন্তুষ্ট হলে সোসাইটির শেয়ার হস্তান্তর অনুমোদন করবে।’ কিন্তু মোহাম্মদ রাশেদের পাঁচটি শেয়ার তার ওয়ারিশদের নামে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রচলিত এসব নিয়ম কানুন মানা হয়নি। এই শেয়ার ওয়ারিশদের নিকট হস্তান্তরের জন্য কোনো আবেদনই করা হয়নি। জমা দেয়া হয়নি ওয়ারিশান সনদ এবং ডেথ সার্টিফিকেট। অথচ এই শেয়ার প্রথমে মোহাম্মদ রাশেদের স্ত্রী চেমন আরা বেগমের নামে ট্রান্সফার দেখানো হয়েছে। আবার চেমন আরা বেগমের কাছ থেকে ওই শেয়ারগুলো মোহাম্মদ সাজ্জাদের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই হস্তান্তর করানোর জন্যও কোনো আবেদন করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন মরহুম মোহাম্মদ রাশেদের স্ত্রী চেমন আরা বেগম।
উক্ত পাঁচটি শেয়ার ট্রান্সফারের ব্যাপারে সমিতির সভায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘মিসেস চেমন আরা বেগম, সোসাইটির ১৫০২ নম্বর সদস্য। তিনি তাঁর ৫টি শেয়ারই সোসাইটির ৩০৩৯ নম্বর সদস্য মোহাম্মদ সাজ্জাদ, পিতা আবুল কাশেম এর নিকট হস্তান্তরের আবেদন করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে মিসেস চেমন আরার ৫টি শেয়ার মোহাম্মদ সাজ্জাদের নামে হস্তান্তর করা হয়। সোসাইটির আইন অনুযায়ী চেমন আরার ১৫০২ নম্বর সদস্য পদটি বিলুপ্ত করা হয়।’ দ্য চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের সভার উক্ত সিদ্ধান্তে মিসেস চেমন আরা বেগমের পাঁচটি শেয়ার মোহাম্মদ সাজ্জাদকে হস্তান্তর করা হলেও চেমন আরা বেগম সোসাইটি অফিসে হাজির হয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, তার স্বামী মোহাম্মদ রাশেদের শেয়ার বিক্রি তো দূরের কথা, তার নামে আনার জন্যও কোনো আবেদন তিনি করেননি। তার মরহুম স্বামীর শেয়ার জালিয়াতির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে। আবার যে মোহাম্মদ সাজ্জাদের নামে ওই শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে তিনি সোসাইটির সম্পাদক, বহুল আলোচিত মোহাম্মদ শাহজাহানের ছোট ভাই। চেমন আরা বেগম মৃত স্বামীর শেয়ার নিজের নামে করানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে সোসাইটি কার্যালয়ে না গেলে জানতেই পারতেন না যে, তার মরহুম স্বামীর শেয়ার জালিয়াতির কবলে পড়েছে। সেগুলো গায়েব করে দেয়া হয়েছে। তিনি কখন কিভাবে মরহুম স্বামীর শেয়ারের মালিক হলেন, কখন মোহাম্মদ সাজ্জাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করলেন জানতে চেয়েও সমিতি থেকে কোনো সদুত্তর পাননি বলেও জানান। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রতিকার চেয়েও তিনি পাননি। অথচ ওই শেয়ার নিজের নামে করিয়ে সোসাইটি সম্পাদকের সহোদর মোহাম্মদ সাজ্জাদ নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন।
শুধু মোহাম্মদ রাশেদের শেয়ারই জালিয়াতির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়নি, আরো অনেকের শেয়ারই এভাবে কেলেংকারির কবলে পড়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সূত্র বলেছে যে, সোসাইটির ৫৪৩ নম্বর সদস্য মঞ্জুরুর রহমানের শেয়ার ফাতেমা নুজহাত নাফিসা নামের একজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু মঞ্জুরুর রহমান সদস্য হয়েছিলেন ১৯৫৯ সালের ২৯ নভেম্বর। তখন তার বয়স ছিল ৪৫ বছর। ২০২০ সাল পর্যন্ত যদি তিনি বেঁচে থাকেন তাহলে তার বয়স হওয়ার কথা ১০৬ বছর। ১০৬ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধের শেয়ার ট্রান্সফারের বিষয়টি নিয়েও ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক খোঁজাখুজি করেও মঞ্জরুর রহমানের কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ উঠেছে, এভাবে অসংখ্য শেয়ার নিয়ে নানা জালিয়াতি ঘটেছে দ্য চিটাগাং কো অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের ভিতরে। প্রচলিত নিয়ম কানুন না মেনে সোসাইটির মৃত সদস্যদের শেয়ার একের পর এক হস্তান্তর করা হচ্ছে। মৃত সদস্যদের আত্মীয় স্বজনদের অগোছরে শেয়ার ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। গত তিন মাসে সোসাইটিতে শেয়ার ট্রান্সফারের মাধ্যমে অন্তত ২০০ জনকে নতুন সদস্য করা হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে মাত্র তিন মাসে দুইশ’ জনের ভোটার হওয়ার রেকর্ড অতীতে কখনো ছিল না বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অতীতে দশ বছরেও এত শেয়ার ট্রান্সফার হয়নি। শেয়ার কেলেংকারির মাধ্যমে অর্থ হাতানোই শুধু নয়, নির্বাচনকে প্রভাবিত করারও সুক্ষ্ম একটি অপতৎপরতা চলছে। ইতোমধ্যে ভোটার লিস্ট নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা ক্ষোভ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সোসাইটির শেয়ার ট্রান্সফারের প্রচলিত নিয়ম রয়েছে। যে কোনো শেয়ারহোল্ডারই ইচ্ছে করলে নিজের শেয়ার হস্তান্তর করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রচলিত নিয়ম না মেনে বিপুল সংখ্যক শেয়ার হস্তান্তরের ঘটনার সাথে ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং সাব কমিটির কয়েকজন সদস্যের পাশাপাশি জেলা সমবায় অফিসের অনেকেই জড়িত বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান নিজের সময়কালে করে যাওয়া নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে নিজের সহোদরকে কমিটিতে আনার এই বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন।
কয়েকজন সদস্য জানান, সোসাইটির সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের নানা পদে থেকে সোসাইটিকে টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত করার অভিযোগ রয়েছে। সোসাইটির অন্যতম প্রকল্প নগরীর অভিজাত আবাসিক এলাকা খুলশীতে ৭.১৮ কাঠা জমি মাত্র ৫৭ লাখ টাকায় বিক্রি করার মত ঘটনায় প্রথম তার নাম আলোচনায় উঠে আসে। সমিতির সভাপতি আ জ ম নাছির উদ্দিনের ২০১৪ সালের বার্ষিক সাধারণ সভার রিপোর্টে প্লট কেলেংকারির জন্য মোহাম্মদ শাহজাহানকে দায়ী করা হয়। অথচ পরবর্তীতে সেই মোহাম্মদ শাহজাহানই আ জ ম নাছির উদ্দিনের প্যানেলের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্লট কেলেংকারির ওই ঘটনা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে বলেও সোসাইটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে। জাল দলিল করেও সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে। নানা ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত মোহাম্মদ শাহজাহান এবং তার ভাই মোহাম্মদ সাজ্জাদ সোসাইটিকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। চট্টগ্রামের অন্যতম অভিজাত এই সোসাইটিকে দুর্নীতির আখড়া বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ করে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সমবায় সমিতি অধিদপ্তরে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। সোসাইটির নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও ভোটার তালিকাসহ নানা বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে সাধারণ সদস্যদের।
গতকাল সোসাইটির একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহানের মোবাইলে ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। জেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ শেখ কামাল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, অনিয়মের কোন ধরনের অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশে সাত মাসে সর্বোচ্চ শনাক্ত ২৮০৯, মৃত্যু ৩০ জনের
পরবর্তী নিবন্ধএক নারীর সাজা খাটছেন অন্য নারী!