‘জাতীয়তাবাদ একটি আদর্শ, যেখানে জাতিকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয় এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শকে জাতিগত আদর্শের পরে স্থান দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে চিহ্নিত “জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা”- এ চারটি বিষয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয়তাবাদকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি ‘জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে এক পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোন জাতি এগোতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি।এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন সকলের সাথে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। অনেক দেশ আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু; কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির ওপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ।” বঙ্গবন্ধু সাধারণ কথায় ‘জাতীয়তাবাদকে’ পরিচ্ছন্ন রূপে উপস্থাপন করেছেন সকলের কাছে। প্রকৃত অর্থে জাতীয়তাবাদ হলো সাধারণ লোকের এক একাত্ম অনুভূত যা জনগণকে বুঝতে শেখায়-দেশের স্বার্থই সবার স্বার্থ, দেশের কল্যাণ-অকল্যাণের সাথে জনসাধারণের কল্যাণ-অকল্যাণ নিবিড়ভাবে জড়িত।
মূলত: বঙ্গবন্ধু,বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তবাদ একসূত্রে গাঁথা। একটি দেশের মানুষ একত্র হয় জাতীয়তায় এবং সংঘবদ্ধ থাকে তাদের জাতিগত সাংস্কৃতিক চেতনায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেটা জানতেন। বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করতে শিখিয়েছেন জাতিকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হওয়ায় এ ভূখণ্ডের যে হিন্দু ও মুসলমান ভারত হতে আলাদা হয়ে পড়ে তিনি তাদের সকলকে একত্রিত করে এক অখন্ড বাঙালি জাতিতে পরিণত করেন। তিনি বলেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় এমন দাগ মেরে দিয়েছে যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকবার জো টিও নেই। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিসত্তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরণপণ চেষ্টা করেছেন এবং সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর একটি অনেক বড় দার্শনিক পরিচয় হলো ‘বাঙালি’ এবং ‘মানুষ’। তাই তিনি দ্বর্থ্যহীন ভাষায় উচ্চারণ করেন, “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।” তাঁর এ কথার গভীর অর্থ যেমন আছে, তেমন আছে গভীর দূরদর্শিতা। আমরা ভাষাভিত্তিক জাতি। তাই তিনি বলেছিলেন, আমি বাঙালি। এই বাঙালি শব্দটিতে আমরা একত্র। এ শব্দটিতেই আমরা সবকিছুর উর্দ্ধে গিয়ে হই সংঘবদ্ধ। জাতির জনকের কাঙ্খিত ঐক্য এর মাধ্যমেই প্রকাশিত। মানুষ সমাজ দ্বারা ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু ভালভাবেই বুঝতেন সভ্য জীবন প্রণালির জন্য মানুষের ঐক্যবদ্ধ থাকার বিকল্প নেই। এরপর তিনি বলেছেন, আমি মানুষ- এর অর্থ আরও গভীর। তিনি বুঝিয়েছেন- আমরা মানুষ, আমরা মানবিক। সকল জীবের মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র মানুষই মনুষ্যত্ব ধারণ করে। তিনি মানুষে মানুষে বিভেদ বৈষম্য পরিহার করে সবাইকে একটি মানবিক ছাতার নীচে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান করেছেন। শেষে বলেছেন, আমি মুসলমান। গভীর দর্শন দৃষ্টিকোণে তিনি কথাগুলো অকপটে বলে গেছেন যাতে ধর্মের সাথে জাতিগত সংস্কৃতির কোন সাংঘর্ষিকতা তৈরি না হয়। মানুষের ধর্মান্ধ মনের দুয়ার খুলে দিয়ে পরস্পরকে সম্প্রীতির আঁচলে আবদ্ধ করে সবার মাঝে বাঙালি অনুভূতি জাগ্রত করার আহ্বান করলেন। তিনি সকলের কাছে স্পষ্ট করলেন- আগে মানবতা, তারপর জাতিসত্ত্বা, পরে ধর্ম।
এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত এবং তার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। আর তা শুধুমাত্র ঘটনা নির্ভর নয়, চেতনা নির্ভর। তার সাথে আমাদের এ ভূখণ্ডের মানুষের সংস্কৃতি অর্থাৎ ভাষা, সামাজিক আচার-আচরণ, রীতিনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম ও জীবনের যাবতীয় বিষয় যুক্ত। আমাদের স্বাধীনতার চেতনার মূল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর রাজনৈতিক দর্শন ছিল বাঙালি জাতিসত্তা আর বাঙালি জাতীয়তাবোধ। সেই জাতীয়তাবোধ আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন্ সময়ে বাঙালি জাতিসত্তার উপর নানান আঘাত এসেছে। ইংরেজ আমলে বাঙালিরা বিদ্রোহ করে, অস্ত্র ধারণ করে- কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নয়। তারা বাঙালি হয়েও সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বপ্নচোখে ইংরেজদের সংগে পাঞ্জা ধরে- কেউ হিন্দু পরিচয়ে বা মুসলিম পরিচয়ে। দ্বিজাতি তত্ত্বের দৌরাত্ম্যে হিন্দু-মুসলমান বেনিয়াদের বিরাট স্বার্থনির্ভর গভীর হিসাব-নিকাশপূর্ণ ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতির ফল হলো পাকিস্তান নামের ভূখণ্ড। একই রাজনীতির সওয়ার পাকিস্তানি শাসকচক্রের নানা ছলচাতুরি- হত্যা-শোষণ-নির্যাতনের হীন ঘৃণ্য ভয়াবহ লীলাখেলাই পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস। এ পুরো সময়জুড়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের আক্রোশের শিকার হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বারবার। উদ্দেশ্য, সবাইকে সে তত্ত্বের ফাঁদে ফেলানো, দলে ভেড়ানো; দাঙ্গা-হাঙ্গামাও বাঁধানো হয়েছে একই উদ্দেশ্যে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের মধ্যে তীব্র দ্বিজাতি তত্ত্বের মনোভাব ছিল। হিন্দু-মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাদের মনে এক ধরনের সামপ্রদায়িকতা বোধতো ছিলই, তাছাড়াও বাঙালি বলতেই ছিল প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা আর বৈরিতা। এ মানসিক অনুভূতি তাদের শাসন আর শোষণের তীব্রতাকে বাড়িয়েছিল। এভাবে একাত্তরের যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বাঙালি আর অবাঙালির তীব্র লড়াই।এটা মূলত: বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের মিশ্রিত এক নৃশংসতা। একদিকে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-নির্যাতনের শিকার ক্ষোভিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার-স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্খা ও লড়াই, অন্যদিকে বহুকালের সুবিধাভোগী অবাঙ্গালি শাসক-শোষক শ্রেণির শাসন-শোষণ-নির্যাতন বজায় রাখার উন্মত্ত অমানবিক আকাঙ্খা ও তার হিংসাত্মক বাস্তবায়ন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদ বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্পীকারের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “স্যার, আপনি দেখেন, ওরা পূর্ববাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান রাখতে চায়। আমরা দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে ‘বাংলা’ নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আর আছে একটা ঐতিহ্য।” ১৪ বছর পর ১৯৬৯ সালের ৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, আজ হতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ না শুধু “বাংলাদেশ’’। ছয় দফা ঘোষণা দিয়ে তিনি ‘গণসংগ্রাম- নির্বাচন-সশস্ত্র যুদ্ধ’ এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ঐতিহাসিক সমন্বয় ঘটালেন। তিনি দ্বিজাতি তত্ত্ব পরিহার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অনুভূতিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষে সংগ্রামের মানস গঠনের রাজনীতি উপহার দিলেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে “জয় বাংলা” শ্ল্লোগান জাতীয় শ্ল্লোগানের রূপ নিয়েছিল। সেই সময় শ্লোগান হয়েছিল’ … তুমি কে, আমি কে! বাঙালি বাঙালি…।’ ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ মোদ্দাকথায় জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সমগ্র জাতি ১৯৭১ সালের সংগ্রামের জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিসত্তাকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। একজন খাঁটি বাঙালির অনন্য দৃঢ়তা ও অনেক গর্বে তিনি নিজেকে এবং এ জাতিকে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রতিভাকে ঘিরে বাঙালির স্বপ্নের রূপকার হিসেবে তিনি “রাজনীতির মহাকবি” আখ্যায়িত হয়েছেন এবং স্বীকৃতি পেয়েছেন “হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি” রূপে। তিনি হয়ে উঠলেন বাঙালির নয়নের মনি, বঙ্গবন্ধু।
বস্তুত একটি জাতি রাষ্ট্র গঠনে তাঁদের জাতীয়তাবাদের দর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দুর্বল হলে ঐ জাতি শক্তিহীন হয়ে পড়ে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, “কোনো জাতি ও রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, সে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না এবং জনগণ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে না। আমাদের জাতি ও রাষ্ট্রের দার্শনিক ছিলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের জাতিসত্তার উপর পাকিস্তানিদের কঠিন আঘাতের মাধ্যমে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর বাঙালি সত্তার। ৭ জুন ১৯৭২, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলার সভ্যতা, বাঙালি জাতি-এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে।” তিনি নিজের ত্যাগ তিতিক্ষা ও জীবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়েও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। বাঙালি জাতিসত্তার উপর যখনই আঘাত এসেছে তখনই বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদমুখর হয়ে সেই আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আজন্ম লড়াই করে গেছেন সারা বিশ্বের দরবারে বাঙালিকে একটি উন্নত জাতি হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য। মৃত্যুভয়ও তাকে কখনো তার বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তার অবস্থান থেকে এক বিন্দু নড়াতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু তাই আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক। তিনি তাঁর উন্নত এবং মহৎ কর্মগুলোর মাধ্যমে বাঙালি স্বত্বাকে প্রতিষ্ঠা করতেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক