সবুজ হোটেলের আড্ডায় আমাদের মধ্যে প্রথম যিনি পাহাড় জয় করেছেন, তিনি কবি হাফিজ রশিদ খান। একেবারে বান্দরবানে নিজেকে বাসিন্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে শিক্ষকতা করতে লাগলেন ডন বসকো স্কুলে নব্বইয়ের দশকে। সেখান থেকে প্রতি বিষ্যুদবার ও শুক্রবারে চট্টগ্রাম ফিরে আমাদের জমিয়ে রাখতেন তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা ও নতুন সৃষ্টির উচ্ছ্বাসে। মাঝে মাঝে সাথে নিয়ে আসতেন বান্দরবানের বন্ধু ও সহকর্মীদেরও। তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষক (সম্ভবত নুরুল ইসলাম সাহেব) এভাবে আমাদের আড্ডায় যোগ দিতে এসে আমাদের বন্ধু হয়েছিলেন। এদিকে হাফিজ ভাই বান্দরবানে খুঁজে বের করেন সাহিত্য সংস্কৃতির অনুরাগী কিছু বন্ধু; এবং তাদের নিয়ে আসতেন সবুজ আড্ডায়; পরিচয় করিয়ে দিতেন আমাদের সাথে। সবুজের অবারিত দ্বার সকলের জন্যেই উন্মুক্ত সবসময়। এভাবে পাহাড়ী বন্ধুরা আমাদের সঙ্গী হয়ে যান, হয়ে যান আত্মার আত্মীয়।
এমন বন্ধুদের মধ্যে দুজন খুব বেশি করে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন আমার সাথে, আমাদের সাথে। একজন চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া এবং অপরজন মংক্যশোয়ে ন্যু নেভি। উল্লেখ্য বাবুল বড়ুয়া যথার্থ অর্থে পাহাড়ী নৃগোষ্ঠীর লোক নন। কিন্তু দীর্ঘজীবন বান্দরবান এবং পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব বেড়ে ওঠা এবং বসবাস করায় তিনি তার বাইরেও কেউ নন। হাফিজ রশিদ খান এবং চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া যৌথ সম্পাদনা করেন ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’ নামে একটি ছিমছাম নান্দনিক ছোটকাগজ। সম্ভবত সবগুলো সংখ্যাতেই আমার কবিতা তাঁরা ছেপেছিলেন।
চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া ছিলেন নীরবে নিভৃতে থেকে কাজ করে যাওয়া লোক। কারও সাথে উচ্চবাচ্য তাকে করতে দেখিনি। আড্ডায় বলার চেয়ে শোনার দিকেই ছিল বরাবরের ঝোঁক। তারপর যখন কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতেন, তা এত মার্জিত সৌজন্যের সাথে যে এটা সকলের জন্যেই শিক্ষণীয়।
একবার গিয়েছিলাম চৈত্রসংক্রান্তি তথা সাংগ্রাই অনুষ্ঠান দেখতে। রাজার মাঠে বিশাল আয়োজনে তরুণেরা তরুণীদের জল ছুঁড়ে ছুঁড়ে হয়তো জানাতে চাইছে মনোবাঞ্ছা। মাঠে অনেক ভীড়, তার ওপর মাথার উপরে সূর্য ঢেলে দিচ্ছে কড়া রোদ্দুর। দেখি ভীড় ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন বাবুল দা। আমাদের বসানো ও আপ্যায়নের জন্যে তাঁর সে কী তোড়জোড়!
যে মানুষটির পদচারণা ছিল সারা দেশময় এবং দেশান্তরেও, তিনি আর পা ফেলবেন না পৃথিবীর পথে। মানুষের অধিকার, আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে যিনি ছিলেন নিয়ত সোচ্চার, সারাক্ষণ কাঁধে করে বহন করতেন একটি অফুরন্ত সৃজন সম্ভাবনার ঝোলা। তাঁর সেই বিখ্যাত খাদি কাপড়ের্য ঝোলা থেকে বেরিয়ে আসবে না নতুন কোনো ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’ কিংবা তাজা গন্ধের আনকোরা বই। আর তিনি আমার পাশে বসে গুনগুন করে পার্শ্বকথা বলবেন না কবিতা পাঠের আসরে কবিতা শোনার ফাঁকে ফাঁকে। তাঁর এ নির্বাণলাভ সার্থক হোক, এটাই কামনা করি।