নগরীর ভূমির অস্বাভাবিক মৌজা দর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আয়বর্ধক প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর ৫০ একর জায়গায় আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার নির্দেশনা মাস্টার প্ল্যানে আছে। তবে ১৩ বছরেও কোনো আবাসিক এলাকা হয়নি। ভূমির মৌজা দর নিয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া না হলে সরকারি পর্যায়ে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
সিডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নগরীর আবাসন সংকট নিরসন এবং আয়বর্ধক প্রকল্প হিসেবে সিডিএ বিভিন্ন সময় আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে। প্রতি বছর ৫০ একর জমি আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সিডিএর মাস্টার প্ল্যানে নির্দেশনা রয়েছে। স্বল্প দামে জমি নিয়ে উন্নয়ন করে সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষের কাছে বিক্রি করে সিডিএর বেশ লাভ থাকে। অপরদিকে সাধারণ মানুষও সাশ্রয়ী মূল্যে প্লট কিনতে পারেন। আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সিডিএ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে। ফলে এসব ভূমি নিয়ে পরবর্তীতে আইনি জটিলতায় পড়তে হয় না। সিডিএ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১২টি আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে। ওখানে প্লটের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। সর্বশেষ ২০০৭ সালে অনন্যা আবাসিক এলাকা করে। এরপর গত ১৩ বছরে আর কোনো আবাসিক প্রকল্প নেয়নি।
২০১৬ সালে ‘অনন্যা আবাসিক (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি একনেক সভায় ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। পাঁচলাইশ, কুয়াইশ ও বাথুয়া মৌজার ৪১৮.৭৩ একর জমির ওপর এ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল ওই সময়। কিন্তু মৌজা রেট (ভূমির সরকার নির্ধারিত মূল্য) এই প্লট বাস্তবায়ন অনিশ্চিত করে তোলে। পাঁচলাইশ ও কুয়াইশ মৌজার জমির যে মূল্য তার তিন গুণ দাম দিয়ে অধিগ্রহণ করে প্লট তৈরি এবং তা বরাদ্দ দিলে প্রতি কাঠার মূল্য ৩০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এত চড়া দামে কেউ প্লট নেবে না। আবার ভর্তুকি দিয়ে প্লট বরাদ্দ দেয়াও সম্ভব না। ওই অবস্থায় অনন্যা আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পটি চাপা পড়ে যায়।
পরে মন্ত্রণালয় থেকে আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণের জন্য সিডিএকে নিদের্শনা দেয়া হয়। ওই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে সিডিএ পুনরায় অনন্যা আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু ভূমির মৌজা রেট সংকট তীব্র করে। পরবর্তীতে পাঁচলাইশ ও কুয়াইশ মৌজার ভূমি বাদ দিয়ে হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া ও শিকারপুর মৌজায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে শুরুতে প্রকল্প এলাকা ৪১৮.৭৩ একর থাকলেও পরে তা কমে ২৭৬ একর নির্ধারণ করা হয়। এতেও ভূমির মূল্য চড়া হওয়ায় প্লট বিক্রি আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই সংশয় থেকে প্রকল্পটি আবারও চাপা পড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার ভূমি রেজিস্ট্রেশনের ট্যাঙ ফাঁকি ঠেকানোসহ মানুষের সুবিধার জন্য মৌজা দর নির্ধারণ করেছে। এই দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুরু থেকে কিছু সংকট রয়েছে। মৌজা দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাস্তা বা যোগাযোগ সুবিধা বিবেচনা করা হয়নি। ভূমির ধরনকেও দেয়া হয়নি গুরুত্ব। একটি বিশাল মৌজার খানাখন্দ থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের ভূমির একই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে করে রাস্তার পাশের যে ভূমি প্রতি কাঠা ১০ লাখ টাকা, একই মৌজার খানাখন্দও ১০ লাখ টাকা। এই ভূমি হুকুমদখল করতে হলে সরকারকে তিন গুণ মূল্য অর্থাৎ কাঠা প্রতি ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। ওই জমি উন্নয়ন করে প্লট হিসেবে বরাদ্দ করতে হলে কাঠাপ্রতি ৪০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, আগে কোনো ভূমি হুকুমদখল করতে মৌজা দরের দেড় গুণ অর্থ পরিশোধ করতে হতো। কয়েক বছর ধরে তা তিন গুণ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে একটি মৌজার সব ভূমির দর একই হারে নির্ধারণ করায় সংকট তৈরি করেছে।
সিডিএ রাস্তার পাশে না নিয়ে ভেতরের দিকের ভূমি নিয়ে উন্নয়ন করতে আগ্রহী হলেও একই মৌজা রেটের কারণে তাতে সুবিধা করতে পারছে না। এই অবস্থায় শুধু অনন্যা আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্লট নয়, আরো কয়েকটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে হয়েছে সিডিএকে।
সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেন, মৌজা রেট আমাদের জন্য বড় সংকট তৈরি করছে। শহরে কিংবা ধারে কাছে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। শহর থেকে বেশি দূরে গিয়ে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হলে তা-ও সফল হবে না। মৌজা রেটের তিন গুণ অর্থ পরিশোধ করার পর ভূমি উন্নয়ন করে সাশ্রয়ী মূল্যে প্লট বরাদ্দের কোনো সুযোগ নেই। বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কে সিডিএ থেকে প্লট নেবে? তিনি বলেন, প্রচলিত বাজারদর এবং রাস্তা বিবেচনা করে একটি যৌক্তিক দর নির্ধারিত হলে সুবিধা হতো।