অর্থনীতির প্রধান দুইটি শাখা হয় মাইক্রো এবং মেক্রো। অর্থনীতিকে সহজভাবে উপস্থাপন করার জন্য বলা যায়, ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও সমষ্টিক অর্থনীতি। ব্যষ্টিক অর্থনীতি যেহেতু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে আলোচনা করে সেহেতু একজন ভোক্তার বা একটি ফার্মের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে ব্যষ্টিক অর্থনীতি। কিন্তু একজন ভোক্তার নিকট সকল পণ্য সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জন্য ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে ভোক্তা কর্তৃক ব্যবহৃত পণ্যগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, বিলাস পণ্য, বিকল্প পণ্য, পরিপূরক পণ্য ইত্যাদি।
বিকল্প পণ্য বলতে সেই সব পণ্যকে বুঝানো হয় যে পণ্যগুলো ভোক্তা একটির পরিবর্তে অন্যটি ব্যবহার করতে পারে। যেমন- চিনি ও গুড়, চা ও কফি, কোডাক ফিল্ম ও ফুজি ফিল্ম ইত্যাদি। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় একজন ভোক্তা চিনির পরিবর্তে গুড়কে ব্যবহার করতে পারে। অথবা গুড়ের পরিবর্তে চিনিকে ব্যবহার করতে পারে। অনুরূপভাবে চা পানের পরিবর্তে কফিকে ব্যবহার করতে পারে। অথবা কফির পরিবর্তে চা পান করতে পারে। এ জন্য চিনি ও গুড়কে বা চা ও কফিকে অর্থনীতিতে বিকল্প পণ্য বলা হয়। অপরপক্ষে ভোক্তার নিকট এমন কিছু পণ্য আছে যে পণ্যগুলোর একটি ব্যবহার করলে অপরটি ব্যবহার করতে হয়। যেমন- ডান জুতা ও বাম জুতা, কারও পেট্রোল, চা ও চিনি ইত্যাদি। একজন ভোক্তা যখন বাজারে থেকে জুতা ক্রয় করতে যায় তখন ডান জুতা ও বাম জুতা তাকে একত্রে ক্রয় করতে হয় (অস্বাভাবিক অবস্থা পরিহার করে)। তিনি কখনো একটি জুতা ক্রয় করবে না। অনুরূপভাবে কার বা মোটরগাড়ি চালাতে হলে অবশ্যই পেট্রোলের প্রয়োজন হয় (গ্যাসের ব্যবহারকে আলোচনায় না এনে)। কাজেই ডান জুতা ও বাম জুতা, মোটরগাড়ি ও পেট্রোল হয় পরিপূরক পণ্য। আরও দুই ধরণের পণ্য আছে যাদেরকে বলা হয় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও বিলাস পণ্য। যে সব পণ্যগুলো জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে অবশ্যই ব্যবহার করতে হয় এসব পণ্যগুলোকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বলে। যেমন- চাল, ডাল, তেল, লবন ইত্যাদি পণ্যগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। জীবন বাঁচার তাগিদে এ পণ্যগুলো অবশ্যই ভোক্তাকে ব্যবহার করতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর মধ্যেও স্থিতিস্থাপকতার পার্থক্য আছে। কিছু কিছু পণ্য আছে যে সব পণ্যের স্থিতিস্থাপকতা শূন্য। যেমন- লবন। ভোক্তার নিকট লবন হচ্ছে এমন একটি পণ্য যা ভোক্তাকে নির্দিষ্ট অনুপাতে ব্যবহার করতে হয়। লবণের দাম কমে গেলে কোন ভোক্তা খুশি হয়ে তরকারিতে বেশি লবণ দেয় না। আবার লবণের দাম বেড়ে গেলে কোন ভোক্তা রাগ করে তারকারিতে কম লবণ দেয় না। এজন্য লবণের দাম কমে গেলে অথবা বেড়ে গেলে ঐ পণ্যের চাহিদা স্থির থাকে। এ কারণে লবণ নামক পণ্যের স্থিতিস্থাপকতা শূণ্য। আর একটি পণ্য আছে বিলাস পণ্য। এ পণ্য ভোক্তা আভিজাত্যতা দেখানোর জন্য অথবা সৌখিনতার জন্য ব্যবহার করে। যেমন- দামী গাড়ি বা কার, সোনা, ডায়মন্ড, দামী ঘড়ি ইত্যাদি। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এসব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশেও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিলাস পণ্যের মধ্যে স্বর্ণের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির কোন লাইসেন্স প্রদান করা হয়নি। শুধুমাত্র ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে স্বর্ণ এসেছে বাংলাদেশে। প্রতি বৎসর ব্যাগেজ রুলের ভেতর দিয়ে যে পরিমাণ স্বর্ণ বাংলাদেশে আসে আর ঐ সময়ে বাংলাদেশের বাজারে যে পরিমাণ স্বর্ণের চাহিদা তার মধ্যে কোন সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। তা হলে বাংলাদেশে এতো দিন স্বর্ণের চাহিদা পূরণ হলো কিভাবে?
এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০-৪০ মেট্রিকটন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ পুরানো স্বর্ণের অলংকার গলিয়ে সংগ্রহ করা হয়। চাহিদার বাকি ৯০ শতাংশ ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে অথবা অন্য পথে এসে স্বর্ণের চাহিদা মিটাতো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে বৈধ পথে দুইভাবে সোনা আমদানি করা যায়। ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে সোনা আমদানি করতে পারে। আবার ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ফেরার সময় ঘোষণা দিয়ে সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম ওজনের সোনার বার নিয়ে আসতে পারে। বৈধভাবে সোনার বার আমদানির জন্য শুল্ককর পরিশোধ করতে হয়। ব্যাগেজ রুলের আওতায় প্রতি ভরিতে ( ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম ) শুল্ককর ২ হাজার টাকা। বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধ পথেও সোনার বার আসছে। যে সব চালান ধরা পড়ছে, সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে অক্টোবর (২০২০) মাসের প্রথম ১৫ দিনে অবৈধভাবে আসা দুইটি বড় চালানসহ মোট ২৮ কেজি ৩১৪ গ্রাম ওজনের সোনার বার জব্দ করেছেন কাষ্টমস কর্মকর্তারা। জব্দ করা চালানের বাইরে অবৈধভাবে আসা কত সোনার বার দেশে ঢুকে পড়ছে, তার হিসাব কারও কাছেই নেই।
করোনা শুরুর পর থেকে অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে দেশের বাজারে স্বর্ণের চাহিদা অনেক কমে গেছে। বিয়ে-শাদিসহ নানা অনুষ্ঠান আগের মত হচ্ছে না। স্বর্ণের চাহিদা কমে যাওয়ার পরও ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ ফেরত যাত্রীদের স্বর্ণ আনার প্রবণতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বৈধ পথে আসা বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে নানা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিমাসে গড়ে ৮৯টি বার বা সাড়ে ১০ কেজি স্বর্ণ ঘোষণা দিয়ে এনেছে যাত্রীরা। করোনার কারণে আন্তর্জাতিক রুটে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে আগষ্ট পর্যন্ত আকাশপথে কোন স্বর্ণবার আনার সুযোগ ছিল না। সেপ্টেম্বরে (২০২০) সীমিত আকারে উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হয়। ফলে বৈধভাবে ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে আবার স্বর্ণ আসা শুরু করে। শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বৈধভাবে ৩ কেজি ৭৯৫ গ্রাম স্বর্ণবার এনেছে যাত্রীরা। অক্টোবর (২০২০) মাসে এনেছে ২ হাজার ২২৪টি স্বর্ণবার, যা ২২ হাজার ২৪০ ভরি বা ২৫৯ কেজির সমান। এসব স্বর্ণবার এনেছে ১ হাজার ২০০ জন বিদেশফেরত যাত্রী, যাঁদের সিংহভাগই দুবাইফেরত। এসব যাত্রীর অধিকাংশের বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে। অথচ ২০১৯-২০ পুরো অর্থ বছরে এ বিমানবন্দর দিযে সব মিলিয়ে ১০৪ কেজি ২৩৫ গ্রাম স্বর্ণবার এনেছিল যাত্রীরা। বৈধপথে স্বর্ণবার আনার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পর দ্বিতীয় স্থানে আছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। জানুয়ারী থেকে অক্টোবর (২০২০) পর্যন্ত সময়কালে এই বিমানবন্দর দিয়ে সব মিলিয়ে ১৪০ কেজি স্বর্ণবার ব্যাগেজ রুলে আনা হয়েছে।
বৈধ ও অবৈধ পথে আসা স্বর্ণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে থাকছে কিনা তা যাচাই করা প্রয়োজন। অন্যথায় এসব স্বর্ণ অন্যত্র পাচার হয়ে এদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ