(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চন্ডীগড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছি আমরা। অপেক্ষা করছেন আরো অনেকেই। অসংখ্য মানুষ। নানা জাতের-নানা বর্ণের-নানা ধরনের। ভারতীয়দের পাশাপাশি প্রচুর পশ্চিমা নাগরিক রয়েছেন বিমানবন্দরে। এই বিমানবন্দরটিই হিমাচল এবং হরিয়ানা প্রদেশের যাত্রীদের আকাশ পথের একমাত্র মাধ্যম। ভারতের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট সিমলাসহ হিমাচল প্রদেশের নানা হিলস্টেশনে আকাশ পথে পৌঁছার পথ এটিই। এতে করে সকালের ফ্লাইট ধরতে যে পরিমান সাদা চামড়ার মানুষ চন্ডীগড়ের এই বিমানবন্দরে এসেছেন ঢাকা বিমানবন্দরে এক মাসেও ওই পরিমান দেখা যায় কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। চারদিকে প্রচুর মানুষ, যাত্রী। এদের অনেকেই ট্যুরিস্ট। আবার অনেকেই সাধারণ যাত্রী। যারা এখান থেকে ভারতের নানা অঞ্চলে ছুটছেন। ভারতে প্রচুর যাত্রী এয়ার ট্রাভেল করেন। বিমানভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় যাত্রীরা অনায়াসে বিমানে চড়তে পারেন। আবার প্রচুর যাত্রী থাকায় ফ্লাইট অপারেটরেরাও কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করতে পারেন। আমাদের দেশে ভাড়া বেশির জন্য সাধারণ মানুষ বিমানে চড়তে পারেন না। আবার যাত্রী কম বলেই অপারেটর ভাড়া কমাতে পারে না। এটি একটি দুষ্টু চক্র। এই চক্র থেকে বের হওয়ার জন্য একটি পথ খোঁজার সময় এসেছে। ভারত সেই পথের নাগাল পেয়েছে, অথচ প্রতিবেশী হলেও আমরা পাইনি।
বিমানবন্দরে গিজগিজ করছে মানুষ। নারী পুরুষ। শিশু কিশোর। কত সাধারণ সব মানুষ বিমান ধরতে ছুটছেন! একা একা চলে যাচ্ছেন অনেক তরুণী। কারো দিকে যেন তাকানোর সময় নেই কারো। সবাই ছুটছেন। জীবনের গতিতে ছুটে চলছে মানুষ। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে নানা কিছু ভাবছিলাম। অকারণ ভাবনা। ঘরনি গল্পে মশগুল। নিশাত ইমরান এবং গুলশান আকতারের সাথে দারুণ সখ্যতা তার। তিনজনই গল্পে গল্পে পার করছে সময়। আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বললেন, ‘চলো, তোমাকে কফি খাইয়ে আনি।’ হেসে উঠলেন স্যার। হেসে উঠলাম আমি। বুঝতে পারলাম যে, স্যারের কফি খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি জানেন যে দুনিয়াতে আর কোন নেশা না থাকলেও চা এবং কফিতে আমার কোন অনাসক্তি নেই। কখনো ‘না’ বলি না। সাতসকালে কিংবা নিশুতি রাতে, কফির মগ হাতে থাকলে আমার দুনিয়া ভরে উঠে। আমি স্যারের পিছু নিলাম। কনফিডেন্স সিমেন্টের কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়াকেও এডিটর স্যার ডেকে নিলেন। আমার ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক, লায়ন সুপ্রভা বৌদি, লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা এবং আমার স্ত্রী বসে থাকলেন। কফি খাওয়ার কোন ইচ্ছে তাদের একজনেরও নেই।
ফ্লাইটের বিলম্ব আছে। আমাদের বোর্ডিং হয়ে গেছে। এখন বিমানবন্দরের যেখানেই থাকিই না কেন, তারা খুঁজে বের করবে। আমাদের রেখে ফ্লাইট উড়াল দেয়ার কোন আশংকা নেই। অতএব মনের মাধুরী মিশিয়ে কফিতে চুমুক দিতে লাগলাম।
এক ঘন্টা বিলম্বে আমাদের ফ্লাইট উড়াল দিল। মাত্র ৪৫ মিনিটের যাত্রা। আকাশ পথে আড়াইশ’ কিলোমিটারের কাছাকাছি দূরত্ব চন্ডীগড় থেকে দিল্লী। এই ৪৫ মিনিটের বিমানযাত্রার জন্য কী কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়!
বিমানযাত্রার দুর্ভোগটা এমনই। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতেও সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিটের মতো সময় লাগে। অথচ শহর থেকে কখনো কখনো দুই ঘন্টা লাগে বিমানবন্দরে পৌঁছতে। আবার ঢাকায় নেমে মতিঝিল বা সন্নিহিত এলাকায় কোন কাজে গেলে লাগে আরো দুই ঘন্টা। এতে করে চট্টগ্রাম থেকে বিমানে ঢাকার মতিঝিল যেতে সময় লাগে গড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা। অথচ রাস্তা ভালো এবং যানজট ফ্রি থাকলে চার ঘন্টায় ঢাকায় যাওয়ার অবকাঠামো আমাদের রয়েছে। রয়েছে ট্রেনে পাঁচ ঘন্টায় ঢাকায় পৌঁছার সক্ষমতা। অবশ্য, আশার কথা হচ্ছে ৫৫ মিনিটে ঢাকা চট্টগ্রাম যাতায়তে সক্ষম ট্রেন চালু করার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। এই ট্রেন আমাদের জীবদ্দশায় চালু হলে একবার চড়বো!
উড়াল দিতে দিতে নামার প্রস্তুতি! দিল্লী ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম আমরা। ভারতের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর। বছরে প্রায় আট কোটি যাত্রী হ্যান্ডলিং করা এই বিমানবন্দরটি পৃথিবীর ১২তম এবং এশিয়ার ৬ষ্ঠ ব্যস্ত বিমানবন্দর। ভারতের বিভিন্ন ফ্লাইট অপারেটর এই বিমানবন্দরটিকে হাব হিসেবে ব্যবহার করে। এতে করে নানা অঞ্চলে যাতায়াতের সময়ও এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে হয়। একবার ব্যাংকক থেকে ফেরার সময় আমি এই দিল্লী হয়ে ঢাকা ফিরেছিলাম। পরে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। অর্থাৎ ব্যাংকক থেকে দিল্লী হয়ে চট্টগ্রাম! ‘বাড়ি কাছে ঘাটা দূরে’র ব্যাপারটি যে কত ভয়াবহ তা ওই যাত্রায় আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
দিল্লীতেও আমাদের থাকা এবং গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন আমার ট্যুর অপারেটর লায়ন আনোয়ারুল আজিম। গেট থেকে বের হওয়ার সময় আমার এডিটর স্যারের নামের প্ল্যকার্ড হাতে নিয়ে একাধিক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমরা কাছে আসতেই লাগেজ তারা নিয়ে নিলেন। আমাদের পথ দেখিয়ে তারা কিছুটা সামনে নিয়ে গেলেন। বিমানবন্দরের বাইরে একটি জায়গায় আমাদের দাঁড়াতে বলে তারা গাড়ি আনতে চলে গেলেন। আমার ধারণা ছিল আবারো বড় ধরনের একটি গাড়ি এসে সামনে দাঁড়াবে। ট্রাক ট্রোক টাইপের কিছু একটা দিয়ে দিলেও আশ্চর্য হবো না। কারণ আমাদের রিসিভ করতেও চারজন লোক এসেছেন। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে টের পেলাম যে, ওই চারজনই আসলে ড্রাইভার। আমাদের প্রত্যেক ফ্যামিলির জন্য একটি করে গাড়ি দেয়া হয়েছে। চারটি গাড়িই এখন বিমানবন্দর থেকে আমাদের নিতে এসেছে। এই চারটি গাড়ি আগামী সপ্তাহ খানেক আমাদের সাথে থাকবে। যেখানে যেতে চাই নিয়ে যাবে। বিষয়টি ভালো। আরামে পথ চলা যাবে। কিন্তু দল বেঁধে গল্প করতে করতে পেটে পিঠে খিল ধরিয়ে পথ চলার আনন্দটা যে মাটি হয়ে যাবে! প্রত্যেক গাড়িতে আমরা দুজন করে উঠলাম। সাথে আমাদের লাগেজও। স্যার বললেন, হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করবেন। আমরা আগে পৌঁছলে অপেক্ষা করবো আমরা।
বেশ জমকালো একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। বিশাল লবি। চমৎকার সব আয়োজন। আমরা গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই ব্যাগ ব্যাগেজ নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে হোটেলের লোকজন। আমরা লবিতে পৌঁছলাম। এডিটর স্যার এবং ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছেন। লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং সুপ্রভা বৌদি পৌঁছাননি। পৌঁছেন নি লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান চৌধুরীও। আমরা একপাশে সোফায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের হাতে ওয়েলকাম ড্রিংকস দেয়া হলো। মখমলের কাপড় মোড়ানো ট্রে থেকে গ্লাসে গ্লাসে দেয়া হচ্ছিল ড্রিংকস। কোমল এই পাণীয়ের চেয়ে পরিবেশনের নান্দনিকতা নজর কাড়ছিল।
আমাদের পৌঁছার খবর পেয়ে ছুটে আসলেন লায়ন মনজুর আলম। তিনি রুমেই ছিলেন। সাথে রাশু ভাবীও লবিতে নেমে এলেন। লায়ন মনজুর আলম রাশু ভাবীকে রিসিভ করতে সিমলা থেকে চলে আসেন। এতে করে আমরা চেইল এবং চন্ডীগড়ে বেড়ালেও মনজু ভাই দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। আজ থেকে আবার আমরা একই দলে যুক্ত হয়ে গেলাম। তবে পৃথক পৃথক গাড়ির কারণে ‘এক হয়েও যেন হলো না’ অবস্থা তৈরি হতে চলেছে। আগামী দিন কয়েক আমরা একই হোটেলে একই সাথে থাকলেও ঘোরাঘুরি হবে আলাদা আলাদা গাড়িতে। তবুও একই সাথে থাকবো, এটাও কম কিসে!
একে একে আমাদের সবাই এসে পৌঁছালেন। হোটেলের রিসিপশনে পাসপোর্ট জমা দিয়ে আমরা রুমের চাবি নিলাম। আমাদেরকে একই ফ্লোরে রুম দেয়া হয়েছে। সাত তলায়। হোটেলটির কয়েকশ’ রুমের পাঁচটিতে আমরা।
দিল্লী শহরে অতীতে আরো বহুবার আসা হয়েছে আমার। এখানকার দর্শনীয় প্রায় সবকিছুই আমার দেখা হয়েছে আগে। স্ত্রীকে নিয়েও আগে একবার দিল্লী এসেছিলাম। এতে করে দিল্লীর সফরটা ঠিক কোনদিক থেকে শুরু করবো তা নিয়ে ভাবছিলাম। আমার এডিটর স্যার এম এ মালেক এবং লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া বললেন, উনাদের তেমন কোন ঘোরাঘুরির ইচ্ছে নেই। তবে আমরা যেন মন ভরে ঘুরে নিই সেই পরামর্শ দিলেন। লায়ন মনজুর আলম এবং রাশু ভাবীর শপিং-এর ইচ্ছে বেশ প্রকট বলে মনে হলো। অথচ আমাদের দুজনেরই সেদিকে কোন ঝোঁক নেই। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলাম। সে সব কিছু আমার ঘাঁড়ে তুলে দিয়ে বললো, ‘যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যাবো, যা দেখাবে তাই দেখবো। আমার বাড়তি কোন ইচ্ছে নেই।’ আহারে আমার সুবোধ ঘরনি! বছরের পর বছর ধরে এভাবে নিজের সব ইচ্ছে-অনিচ্ছাকে আমাতে বিলীন করে বসে আছে। এতে সে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেও আমার দায় বহুলাংশে বেড়ে গেছে। সে দায় মাথায় নিয়ে কোত্থেকে শুরু করবো বা আদৌ কিছু করতে পারবো কিনা তা ভাবতে লাগলাম। (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।