নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন

প্রফেসর সালমা রহমান | বুধবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ


নারী শিক্ষা, নারী প্রগতি, নারী আত্মকর্মসংস্থানের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন আজ থেকে প্রায় এক শত চল্লিশ বছর আগে । ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। তখন বাড়ির বাইরে যেয়ে মেয়েদের পড়ালেখার কোন সুযোগ ছিল না। বড় বোন করিমুন্নেসা ছিলেন বিদ্যোৎসাহী, বিশেষ করে বাংলার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালবাসা। শৈশব থেকে রোকেয়া বড় ভাই ও বোনের কাছে বাংলা শিখতে শুরু করেন। গৃহ শিক্ষকের কাছে আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। বাংলার মুসলিম সমাজের দুর্দশা দেখে সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন বাংলায়। তিনি বুঝেছিলেন অন্তঃপুরে থাকা নারী মনে চেতনা জাগ্রত করতে,আত্মশক্তির বীজ বপন করতে কেবল মাতৃভাষাতেই সম্ভব। পারিবারিক, সামাজিক রীতির বিরুদ্ধচারণ করে বাংলায় সাহিত্য চর্চা ছিল তাঁর প্রথম নীরব বিদ্রোহ। এজন্য তাঁকে যথেষ্ট বাধা ও অপবাদ সইতে হয়েছিল। আপন আলোয় পৃথিবী দেখা প্রয়োজন, এজন্য তিনি নারীর অন্তর-বাহিরের উৎকর্ষ সাধনে কাজ করেছেন সারা জীবন। রোকেয়ার প্রকৃত লেখাপড়া ও সাহিত্য চর্চা শুরু হয় বিয়ের পর। মাত্র ষোল বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়, স্বামী খান বাহাদুর শাখাওয়াত হোসেন ছিলেন বিহারের ভাগলপুরের উচ্চ শিক্ষিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট । স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনি ভালভাবে ইংরেজি ভাষাও রপ্ত করেন। ১৯০২ সালে কলকাতার “নবপ্রভা” পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প “পিপাসা” প্রকাশিত হয়। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি নারী শিক্ষা বিস্তারে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা পেলেই নারী মেধায়, বুদ্ধিতে পুরুষের সমান হয়ে উঠবে, নারী শিক্ষিত নাহলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর উনত্রিশ বছর বয়সে ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন “শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল”। সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় বাধা,কঠিন পর্দাপ্রথা ভেঙে স্কুলে ছাত্রী সংগ্রহ করা ছিল দুরুহ কাজ, তিনি পর্দা রক্ষা করে বাড়ি বাড়ি যেয়ে অভিভাবকদের বুঝাতে লাগলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের নিয়মের মধ্যে থেকেই সমাজ বদলাতে হবে। তাঁর প্রখর দূরদৃষ্টি, আত্মত্যাগ, পরিশ্রম ও অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতায় মাত্র পাঁচ জন ছাত্রী দিয়ে শুরু করা স্কুলটি পূর্ণাঙ্গ গার্লস হাইস্কুলে পরিণত হয়। তবে এজন্য ১৯০৯ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
১৯০৯ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর থেকেই বিষয় সম্পত্তি নিয়ে স্বামীর প্রথম পক্ষের মেয়ে ও জামাই ঝামেলা শুরু করে। কারণ স্বামীর জমানো টাকার মধ্যে দশ হাজার টাকা রোকেয়াকে দিয়েছিলেন, বাকী সব টাকা ও জমি মেয়ের নামে লিখে দেন। তিনি ১৯১০ সালে কলকাতায় চলে আসেন এবং ১৯১১ সালে ১৩ নম্বর অলিউল্লাহ লেনে স্কুল শুরু করেন, তখন ছাত্রী ছিল আট জন। পরের বছর ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে ৭২ জন হয় এবং প্রথম মাসিক সরকারি সাহায্য আসে ৭১ টাকা। ১৯১৩ সালে আবার স্কুল স্থানান্তরিত হয় ১৩ নম্বর ইউরোপীয় এ্যাসাইলাম লেনে। সে বছর ছাত্রীদের জন্য ঘোড়ার গাড়ি কেনা হয়,এজন্য সরকারি সাহায্য আসে ৭৫০ টাকা। এই গাড়ীটি পর্দা ঘিরে মেেেয়রা স্কুলে আসা যাওয়া করত। ১৯১৫ সালে আবার স্কুল স্থানান্তরিত করা হয় ৮৬/এ লোয়ার সার্কুলার রোডে। সে বছর ছাত্রী সংখ্যা ছিল ৮৪ জন। ১৯১৭ সালে তিনি স্কুলে বাংলা শাখা প্রবর্তন করেন, দুই বছর পর ছাত্রীর অভাবে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩০ সালে দশম শ্রেণী চালুর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৩২ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে স্কুলটি পঞ্চম বারের মত ১৬২ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে স্থানান্তর করতে হয়। ভাড়া বাড়িতে স্কুল চালু করায় বার বার জায়গা বদল করতে হয়েছে, তাছাড়া স্কুলের জন্য অর্থ যোগাড়, ছাত্রী যোগাড়, সামাজিক নানা বাধা মোকাবেলায় আজীবন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য থেকে একটুও বিচ্যুত হননি।
নারী শিক্ষার পাশাপাশি তাঁর সামাজিক চেতনার শক্তিশালী লেখনীতে নারীর অমর্যাদাকর অবস্থা তুলে ধরেছেন। তিনি শুধু নারী জীবনের অসহায়ত্ব ও হতাশাকে বড় করে দেখেননি, স্বাবলম্বী হয়ে নারী মুক্তির পথও দেখিয়েছেন। বেগম রোকেয়ার একমাত্র উপন্যাস “পদ্মরাগ” যেন তাঁর চিন্তা, চেতনার সার্বিক রূপ প্রকাশ করে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সিদ্দিকা জ্বলন্ত অগ্নিকন্যা স্বরূপ। সিদ্দিকা নারী মুক্তির একটা সুপরিকল্পিত চরিত্র, কার্যত আত্মনির্ভরশীলতার বাস্তব শিক্ষা কার্যক্রমের কেন্দ্র হচ্ছে তারিনীভবন। যেখানে নারীরা সহজ সরল জীবনধারায় পূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে উঠে। পুতুলের জীবন যে নারী জীবন নয়, পুরুষের কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য নারী জীবনের আদর্শ হতে পারে না – এটিই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। সব ধর্ম বর্ণের অপূর্ব মিলন দেখা যায় তারিনীভবনে। চারুবালা দত্ত চিরকুমারী, মিসেস হেলেন ইংরেজ বিধবা, সধবা সৌদামিনী, রাফিয়া স্বামী পরিত্যক্ত – ব্যক্তি জীবনের অপ্রাপ্তি বড় করে না দেখে মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করাই তারিনীভবন বিদ্যালয়ের শিক্ষা। এখানে কেউ শিক্ষা দান করে, কেউ চরকা কাটে, কেউ সুচিকর্ম করে, কেউ কাপড় বুনে, কেউ মিষ্টি বানায় – চমৎকারভাবে শিক্ষার সাথে কর্মের সমন্বয় করা হয়েছে। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ মতিচুর (প্রথম খণ্ড) প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে, এতে সাতটি প্রবন্ধ স্থান পায়। প্রতিটি প্রবন্ধে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী, কুসংস্কার, বৈষম্য ফুটে উঠেছে বিশেষ করে স্ত্রীজাতির অবনতি প্রবন্ধে ব্যঙ্গাত্মক নানা উপমার সাহায্যে মেয়েদের চেতনায় আঘাত করেছেন। তিনি লিখেছেন- “আর এই যে আমাদের অতি প্রিয় অলংকারগুলি – এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। এখন ইহা সৌন্দর্য বর্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলংকার দাসত্বের নিদর্শন ছিল। তাই দেখা যায় কারাগারে বন্দীগণ পায়ে লৌহ নির্মিত বেড়ি পরে আমরা স্বর্ণ বা রৌপ্যের বেড়ি বা মল পরি। উহাদের হাতকড়ি লৌহ নির্মিত, আমাদের হাতকড়ি স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত চুড়ি । কুকুরের গলে যে গলাবন্ধ দেখি, উহারই অনুকরণে বোধহয় আমাদের জড়োয়া চিক নির্মিত হইয়াছে—” । শিক্ষার আলোয় আলেকিত না হয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্র্য বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। অথচ বর্তমান আধুনিক যুগেও মেয়েরা যেভাবে সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রয়েছে তাতে আর যাই হোক তাদের আধুনিক বলা যাবে না। ১৯০৫ সালে প্রথম ইংরেজি লেখা “সুলতানা’স ড্রীম” মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপানো হয়, পরে ১৯০৮ সালে বই আকারে প্রকাশ পায় এই কল্পকাহিনী ু- সুলতানা অন্তঃপুরে বন্দী এক নারী স্বপ্নে সে সারা নামের অপরিচিতার সাথে বেড়াতে বের হয় । সেটি নারীস্থান যেখানে পুরুষেরা ঘরে বন্দী, নারীর কথা মত কাজ করে। মূলত নারীর মন ও মস্তিষ্কের পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল এই লেখার উদ্দেশ্য। বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্নকে নিজেই অনুবাদ করেন, বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে সুলতানার স্বপ্নকে মাইলফলক হিসাবে ধরা হয়। ১৯৩১ সালে অবরোধবাসিনী প্রকাশ পায়, এখানে ভারতবর্ষের নারী বঞ্চনার খণ্ড খণ্ড চিত্র পাওয়া যায় – যা লেখকের নিজের বাস্তব জীবনে দেখা ঘটনা।
নারী শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চা ছাড়াও তাঁর ছিল অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা – ১৯১২ সালে তার্কিস রিলিফ ফান্ড সভায় বক্তৃতা করে ৩০০ টাকা আগা খান পুরস্কার পান। ১৯১৩ সালে ইংরেজী কবিতা লিখে প্রথম স্থান লাভ করেন। দুস্থ নারীদের সাহায্য করার জন্য ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আন্‌জুমানে খাওয়াতীন ইসলামী মহিলা সংঘ। বার বার তাঁর তাগিদে কলকাতা সরকারি মহিলা ট্রেনিং সেন্টার চালু করা হয়। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির সাথে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। ১৯১৪ সালে ছোটলাট পত্নী লেডী কারমাইকেল স্কুলের জন্য ৩০০ টাকা সাহায্য দেন, হায়দ্রাবাদ থেকে সরোজিনী নাইডু পত্র লিখেন ১৯১৬ সালে। ১৯১৭ সালে বড়লাট পত্নী লেডী চেমসফোর্ড স্কুল পরিদর্শনে আসেন। বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী বেগম রোকেয়া তৎকালীন মৃত সমাজকে আলোর মুখ দেখিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ভোর রাতে,সেদিন রাত ১১ টা পর্যন্ত তিনি লিখছিলেন “নারীর অধিকার ” নামে একটি প্রবন্ধ। আমৃত্যু তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন। তাঁর আদর্শ, চেতনা এখনো নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক; প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ