৯ লাশ শনাক্ত, বাকিরা গণকবরে

লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা পুড়ে যাওয়া লঞ্চে তদন্ত কমিটির সদস্যরা

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

ঝালকাঠিতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে মৃতদের মধ্যে যে ৩৩ জনের লাশ বরগুনায় পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে নয়জনকে শনাক্ত করেছে পরিবার। বাকি লাশগুলো গণকবর দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। শুক্রবার গভীর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুল হতাহতের ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জালাল উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে শুক্রবার রাত সোয়া ১১টার দিকে ৩৩টি মৃতদেহ বরগুনা সদর হাসপাতালে আনা হয়। খবর বিডিনিউজের।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, শনিবার বেলা ১২টার দিকে লাশগুলো সার্কিট হাউজ মাঠে নেওয়া হয়। পরে জানাজা শেষে গণকবরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৩৩ লাশের মধ্যে নয়জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে পরিবার। বাকি লাশগুলো পর্যায়ক্রমে দাফন করা হচ্ছে। নয়জনের লাশ হস্তান্তরের সময় তাদের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। শনাক্ত নয়জনের মধ্যে তিনজনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন বরগুনা সদরের আমতলী নিমতলী এলাকার জাহানারা ও বরগুনা সদরের লেমুয়া খাজুরা এলাকার যমজ দুই বোন লামিয়া ও সামিয়া।
জেলা প্রশাসক বলেন, লাশগুলো বেশিরভাগ পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় চিনতে পারছেন না স্বজনরা। মৃতদেহের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের বরগুনায় পাঠানো থাকা ৩৩ জনের মধ্যে নয়জনকে শনাক্ত করেছে তাদের পরিবার। বাকিদের চিহ্নিত করা না যাওয়ায় গণকবর দেওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা সদরঘাট থেকে কয়েকশ যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিল এমভি অভিযান-১০। চাঁদপুর, বরিশাল ও দপদপিয়া ঘাট পেরিয়ে লঞ্চটি যাচ্ছিল বেতাগী, শেষ গন্তব্য ছিল বরগুনা; শীতের রাতে যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন ঘুমে। রাত ৩টার দিকে কোনো এক সময় চলন্ত লঞ্চে আগুনের সূত্রপাত হয়। ওই অবস্থাতেই এগিয়ে যেতে থাকে অভিযান-১০, এক পর্যায়ে পুরো লঞ্চ পরিণত হয় অগ্নিকুণ্ডে।
প্রাণ বাজি রেখে সেই ঝাঁপ অনেককে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এগিয়ে গিয়ে তাদের তুলে এনেছেন স্থানীয়রা। ফায়ার সার্ভিস, নৌ পুলিশ ও কোস্ট গার্ডও অংশ নিয়েছে উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু উপরের দুই তলার বন্ধ কেবিনে যারা ঘুমাচ্ছিলেন, তাদের অনেকের আর বের হওয়ার সুযোগ হয়নি। সেই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিটের সময় লেগেছে প্রায় তিন ঘণ্টা।
শুক্রবার দিনভর তল্লাশি চালিয়ে পোড়া লঞ্চ আর নদী থেকে ৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করার কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। ঢাকায় নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় দগ্ধ এক শিশুর। আর ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টিউটে পাঠানো হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এক প্রৌঢ়ের। এদিকে আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন লঞ্চের আরও অন্তত ৭০ যাত্রী।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা : যাত্রীবোঝাই লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ঝালকাঠি সদর থানার ওসি খলিলুর রহমান জানান, গতকাল সকালে পোনাবালিয়া ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ জাহাঙ্গীর হোসেন এ মামলা দায়ের করেন।
ঝালকাঠি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি লঞ্চের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ৫১ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে বলে জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী জানিয়েছেন। তিনি বলেন, চূড়ান্ত তালিকা বরগুনা জেলা প্রশাসন তৈরি করবে।
লঞ্চে তদন্ত কমিটির সদস্যরা : ঝালকাঠিতে যাত্রীবোঝাই লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। গতকাল সকালে লঞ্চটি পরিদর্শনে যায় তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তিনতলা লঞ্চটি এখন ঝালকাঠির দিয়াকুল এলাকায় সুগন্ধা নদীর তীরে ভেড়ানো রয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো, নাজমুল আলম বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমরা পরিদর্শনে এসেছি। এখন পর্যন্ত পরিদর্শনে আছি। ইঞ্জিনরুমসহ পুরো লঞ্চটি দেখা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলছি।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা লঞ্চের ইঞ্জিনরুম থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি জায়গা ঘুরে দেখেন। সম্ভাব্য যেসব জায়গা থেকে আগুন লাগতে পারে, সেগুলো চিহ্নিত করেন। প্রথম দিনের কাজ শেষে গতকাল সন্ধ্যায় নাজমুল বলেন, আমরা তিনটি জায়গার প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকারীদের সাথেও কথা বলেছি। প্রথমে লঞ্চঘাটের (ঝালকাঠি নৌবন্দর এলাকার) এখানে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলেছি। এরপর দিয়াকুলে যেখানে লঞ্চটি ভেড়ানো হয়েছিল, সে জায়গার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়দের সাথে, আর আগুন লাগার পর চরকাঠী নামক একটি জায়গায় লঞ্চটি থেমেছিল, ওই জায়গার উদ্ধারকারীদের সাথে তদন্ত কমিটির কথা হয়েছে। এছাড়া ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে দুই ভিকটিমের সাথে তদন্ত কমিটির কথা হয়েছে। বরগুনার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের সঙ্গেও তদন্ত কমিটি কথা বলবে জানান তিনি।
কমিটিকে তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তবে তিনদিনের মধ্যে তা শেষ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে কমিটির সদস্যরা। সেক্ষেত্রে সময় বাড়ানোর আবেদন জানাবেন তারা।
বিয়ের বাজার নিয়ে নিখোঁজ বাবা-মা-ভাই : বড় মেয়ের জন্য বিয়ের বাজার করে বাড়ি ফিরছিলেন বাবা-মা; সঙ্গে পরিবারের আরেক সদস্য, আড়াই বছরের নাসিরউল্লা; তিনজনই নিখোঁজ হয়েছেন ঝালকাঠিতে অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগার পর।
তাদের আত্মীয় নজরুল ইসলাম স্বজনদের খোঁজ না পেয়ে গতকাল সকালে আসেন পোড়া লঞ্চে। লঞ্চের একটি কেবিনে তিনি তার বোন, ভগ্নিপতি ও আড়াই বছর বয়সী ভাগনের জিনিসপত্র শনাক্ত করেন। নজরুল বলেন, তার ভগ্নিপতি হাকিম শরিফ (৫০) ঢাকায় ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। হাকিমের বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের জন্য ঢাকা থেকে কেনাকাটা করে বরগুনার বাড়ির পথে রওনা হন হাকিম। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ও ছোট ছেলে নাসিরউল্লা। বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে ভগ্নিপতির সঙ্গে আমার মোবাইল ফোনে কথা হয়। ভগ্নিপতি বলল, ডেকে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু সঙ্গে টাকা থাকায় কেবিনেই রওনা করি। তারপর তাদের আর খোঁজ মেলেনি। তারা মারা গেছেন বলে আশঙ্কা করলেও নজরুল তাদের লাশ পাননি বলে জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঝরনায় নিখোঁজ ভাইবোনের মৃতদেহ উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধ৬৪ ইউপিতে আজ ভোট