৭ই মার্চের ভাষণ ও অজানা কিছু তথ্য

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান | রবিবার , ৭ মার্চ, ২০২১ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ’র ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে একটি ছোট চিরকুট-এর অলৌকিক অবদান ছিল, সেকথা কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বৃহত্তর চট্টগ্রাম জিলা আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রথম রেডিওতে ঘোষণাকারী মরহুম এম.এ হান্নান জীবিতকালে যে কথাটি একবার স্থানীয় জে.এম. সেন হলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যে উদ্ধৃত করেছিলেন। পাঠকের মনে একথা নিশ্চয়ই খটকা লাগবে যে, এত বছর পর এ ঘটনার কথা কেন বলতে গেলাম এভেবে। পাঠকবৃন্দের সন্দেহ অবিশ্বাস দূর করার জন্য সুনিশ্চিতভাবে অবগত করতে চাই যে, ঘটনাটি সম্পূর্ণ সত্য ও অবিকৃত।
ঘটনার বর্ণনা ঃ ৬ই মার্চ ১৯৭১ সাল। বিকেলের দিকে ১২০ নং আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে আমরা কয়েকজন আন্দোলনের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ এক মধ্যবয়সী লোক অফিসে ঢুকে পড়েন। অচেনা আগন্তুককে দেখে চমকে উঠলাম। নেতৃবৃন্দ অফিসে আসেন না, চারিদিকে থমথমে অবস্থা। সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী, ডিজিএফআই খুবই তৎপর। আমাদের বৈঠকে জেলা আওয়ামী লীগ শ্রম সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক এস.এম. জামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। আগন্তুক ভদ্রলোক সাধারণ পাঞ্জাবী পরা ছিল। ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে জনাব এম.আর সিদ্দিকী ও এম.এ হান্নানের খোঁজ করছিলেন। এতে আমরা বিব্রতবোধ করি এবং সন্দিহান হয়ে উঠি। হঠাৎ সভাপতি ও সেক্রেটারীকে কেন খুঁজছেন তিনি। ভদ্রলোককে ক্লান্ত-শ্রান্ত মনে হল। আমাদের মনের অবস্থা আঁচ করতে পেরে তিনি বললেন ভয় পাবেন না, আমি সিলেট থেকে এসেছি, হযরত শাহ্‌ জালাল(রঃ) এর দরগাহ শরীফের খাদেম উনাদেরকে (সিদ্দিকী/হান্নান) দেয়ার জন্য একটি চিরকুটে পাঠিয়েছেন। সাধারণ খামে ভরা চিঠিটা দেখালেন। হস্তান্তর না করে তিনি বললেন নির্দেশ রয়েছে চিঠিখানা সরাসরি হাতে দেয়ার জন্য। ভদ্রলোকের কথায় আশ্বস্ত হলাম। নেতৃবৃন্দ ঐ সময় এম.আর সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় গোপন বৈঠকে ছিলেন। এস.এম জামাল উদ্দিন ও অপর একজনকে (নাম মনে নেই) সাথে নিয়ে ভদ্রলোক সমেত সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় গিয়ে হান্নান ভাইয়ের হাতে চিঠিটা অর্পণ করে আগন্তুক বললেন খাদেম সাহেব বলেছেন, আগামীকাল ৭ই মার্চ ভাষণ দেয়ার পূর্বে যেন শেখ সাহেবের হাতে এটা পৌঁছানো হয়। হান্নান ভাই চিঠির গুরুত্ব অনুধাবন করলেন এবং সন্ধ্যার পর পরই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। অসহযোগ আন্দোলন চলছিল বিধায় অনেক স্থানে রাস্তা কাটা থাকায় ঢাকায় পৌঁছেন সকাল ১০টার দিকে।
পরবর্তী ঘটনা এম. এ হান্নানের ভাষায় শুনুন ঃ ৭ই মার্চ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ঢুকে ড্রইংরুমে (নিচতলা) ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী গোলাম মোস্তফা ও শেখ নাসের ( বঙ্গবন্ধুর ভাই) সহ কয়েকজনকে বিমর্ষ অবস্থায় দেখতে পাই। গাজী ভাইকে বঙ্গবন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি দোতালার দিকে ইশারা করেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে দরজার সামনে উপস্থিত হয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু হাতে টোব্যাকো পাইপ নিয়ে চোখ বন্ধ করে ইজি চেয়ারে দুলছেন। মনে হল গভীর উৎকন্ঠা আর চিন্তায় ডুবে আছেন। বিষণ্নতার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিরক্ত করা ঠিক হবে কিনা সাত-পাঁচ ভেবে আমি অস্থির। এদিকে সভার সময় এগিয়ে আসছে। এমন সময় বঙ্গবন্ধুর চোখ উম্মিলিত হলো। সাথে সাথে আমি ‘আস্‌সালামু আলাইকুম’ বলে উঠলাম নিজের অজান্তেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, হান্নান তুই কখন এসেছিস, চট্টগ্রামের খবর কি, সব ঠিক আছে তো? (ঠিক আছে তো কথাটি জিজ্ঞাসার পিছনে আরেকটি রহস্য লুকায়িত ছিল পরবর্তী কোন লেখায় এটা বলবো)। আমি বললাম সবই ঠিক আছে। এগিয়ে গিয়ে চিরকুটটা বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়ে বললাম হযরত শাহ জালাল (রঃ)’র খাদেম আপনাকে দিতে বলেছেন। বঙ্গবন্ধু অত্যুৎসাহে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলেন। লক্ষ্য করলাম চিঠি পড়ার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সপ্রতিভ হয়ে উঠেন। কপাল, মুখমণ্ডল, চোয়ালগুলো শক্ত হয়ে ভেসে উঠছে, প্রত্যয়দীপ্ত সাহসী একখানা চেহারা মুহূর্তের মধ্যে ভেসে উঠলো। কিছুক্ষণ পূর্বের বিষণ্নতা কাটিয়ে চিরচেনা বঙ্গবন্ধু ক্রমশ অগ্নিশর্মা হয়ে উঠছেন। চিঠিটা শেষ হলে আমাকে নিচতলা থেকে গাজী ভাইকে ডেকে আনতে বললেন। বঙ্গবন্ধু গাজী গোলাম মোস্তফাকে সভার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়ে তিনি সভায় ভাষণ দিবেন একথা জানিয়ে দিতে বললেন সবাইকে। দোদুল্যমানতা, ভয়-ভীতি, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কাটিয়ে নতুন প্রহরের যাত্রা শুরু হলো। পরবর্তী সব ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। বাঙালির অবিসংবাদিতনেতা রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করলেন- এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ ঘোষণা অগ্নিবীনার সুরের মূর্ছনার মতো দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে সকলের মন প্রাণ ছুঁয়ে গেল। উত্তেজনা, উদ্দীপনা আর অবিনাশী শপথ নিয়ে জনতা ফিরে গেল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। মূল মন্ত্র হলো- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
খাদেমের পাঠানো ঐ চিরকুটে কি লেখা ছিল ? বঙ্গবন্ধু আবেগতাড়িত অনুপ্রাণিত হয়ে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন কেন? হান্নান ভাই বললেন, ৫/৬ লাইনের এ চিরকুটে সাহসের সঙ্গে দৃঢ় প্রত্যয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে এমন বক্তব্য রাখার নির্দেশ ছিল। আল্লাহ্‌ সহায়। বাবার দোয়া রইলো।
প্রাসঙ্গিকভাবে দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম সফরে আস্‌লে শহর কুতুব হযরত শাহ আমানত খান (রঃ) ও মাইজভান্ডার দরবার শরীফ যিয়ারত করেছেন বহুবার। তিনি খাঁটি সুন্নী মতাদর্শ ও পীর-আউলিয়া ভক্ত ছিলেন। আমার মতো অনেকেই এটা জানে। আল্লাহ-জাল্লাশানহুর নির্দেশ ছাড়া বান্দার কোন কাজ সম্পন্ন হয় না। হক্কানী পীর মুর্শিদ, আউলিয়া কেরামগনের কারামত আল্লাহর ইচ্ছাতেই প্রকাশ পায় এবং মখলুকাতের উপকারে আসে। স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশ্বে একটি আধ্যাত্মিক প্রশাসন চলমান, কিয়ামত পর্যাপ্ত এটা চলমান থাকবে। ক্ষমতারোহন, উত্থান-পতন, শাস্তি বিধান সবই ঐ প্রশাসনের সভায় নির্ধারিত হয়। বিশ্বকে ৮০ জন আবদাল পরিচালিত করছেন। আল্লাহ রসুল (দঃ) নেগাহ প্রাপ্ত গাউসে পাক সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী(রঃ)’র পক্ষ হতে আধ্যাত্মিকভাবে আবদাল, ওলী পদবী দান করা হয়। পবিত্র কুরআন করিমে ও হাদীসে পাক এর মাধ্যমে এর সত্যতা প্রমানিত। গাউস কুতুব আবদাল আউলিয়া কেরামদের বন্ধু বলে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন, আমার বন্ধুদের মৃত বলিওনা, তাঁদের নেই কোন ভয়। তাঁদের (অলী) কথা, হাত-পা আমার কুদরতের (আল্লাহ্‌র) নিদর্শন হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুুদ্ধ চলাকালীন আজমীর শরীফে খাজা গরীবে নেওয়াজ(রঃ)’র সালানা ওরশ মুবারকে যোগ দেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল প্রথমবারের মতো। বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ সে ওরশে অংশ নিয়েছিল। আমি খাজা বাবার মাজার যিয়ারতে সব সময় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য দোয়া চাইতাম। ৩য় বা ৪র্থ দিন স্বপ্নে দেখি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে এবং রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সম্মুখে ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। আমি আজমীর হতে টেলিগ্রাম মারফৎ জোনাল কাউন্সিল-১ চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও ক্যাম্প চিফ এম.এ. হান্নান ভাইকে সুখবরটা জানিয়েছিলাম আগস্ট মাসে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও একজন সুন্নী মুসলমান এবং পীর আউলিয়া ভক্ত, এটা প্রমানিত সত্য। আল্লাহ’তালা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হায়াত দারাজ করুন আমিন।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধকালীন লিয়াজোঁ অফিসার, সেক্টর-০১ এবং সাবেক আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগ কর্মকর্তা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাতই মার্চের ভাষণ
পরবর্তী নিবন্ধমহাকাব্যের বিশ্বজয়