৬ দফা এবং ঐতিহাসিক ৭ জুন : বাঙালির জাগরণের ইতিহাস

সৌভিক চৌধুরী | মঙ্গলবার , ৬ জুন, ২০২৩ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

১৯৬৬ সালের ৭ জুন বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অনন্যসাধারণ দিন। এই দিনের আন্দোলন সংগ্রাম এবং হরতালের বৈশিষ্ট্য ছিলো, শ্রমিকশ্রেণীর সক্রিয় সমর্থন ও হরতালের পক্ষে রাজপথে দৃঢ় অবস্থান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় দীর্ঘ ইতিহাসের ফলশ্রুতি। এখানে বলে নেয়া সংগত যে, ৬ দফা কেন্দ্রিক ৭ জুনের ঘটনাবলী হঠাৎ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি জাতির মুক্তি বা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। প্রস্তাবে ভারতের উত্তরপূর্ব ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ প্রতিষ্ঠার কথাই বলা হয়। এই প্রস্তাব ছিলো বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র ভাবনার প্রথম আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন কিন্তু নানা কারণে সে উদ্যোগ সফল হয়নি। কিন্তু তাই বলে বাঙালির স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ভাবনা বিলীন হয়ে যায়নি। ৬ দফার মধ্যেও তার প্রতিফলন দেখা যায়।

১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার সমাধান দিতে পারেনি, বরং শুরু থেকেই বাঙালিদের উপর পাকিস্তানের অপর অংশের ঔপনিবেশিক ধাঁচের শাসনশোষণ ও জাতিনিপীড়ন পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বরূপ উন্মোচন করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ চেতনা জেগে উঠেছিলো, সেই জাগরণ থেমে থাকে নি বরং ৬ দফার ঘোষণায় তা আরো উজ্জীবিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর প্রণয়ন করা ৬ দফাগুলো হল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র পরিণত করা, সকল বিষয় অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশের হাতে থাকা, পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের জন্য পৃথক বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন করা, অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশগুলোর কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখা এবং নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্যারামিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী রাখা।

১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ‘আমাদের বাঁচার দাবী নামে বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী অনুমোদন করিয়ে নেন। ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর এর প্রতি বঙ্গবন্ধু অন্য কোনো দলের সমর্থন পাননি। তাঁর ভরসা ছিল আওয়ামী লীগের একদল পরীক্ষিত নেতা কর্মী, দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব ও ছাত্র যুব সমপ্রদায়। বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে ৬ দফাই যে সঠিক কর্মসূচি সে সম্বন্ধে তাঁর অবিচল বিশ্বাস ছিল। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ৬ দফা পেশ করেন এবং জনগণ এর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে।

৬ দফা কর্মসূচি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তোলে। এ কর্মসূচি ঘোষণার পর আইয়ুব সরকারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। তিনি এর প্রবক্তা বঙ্গবন্ধুকে ‘এক নম্বর দুশমন’ হিসেবে চিহ্নিত করে ৬ দফা পন্থীদের ‘অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের’ হুমকি দেন। জেল থেকে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ৭ জুন, ১৯৬৬, ৬ দফা দাবি আদায় ও গ্রেফতারকৃত নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে প্রদেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নেতা কর্মীরা প্রচার পত্র বিলি করতে থাকে। উল্লেখ্য, এই হরতাল পালনের ব্যাপারে অন্যান্য বিরোধীদল নীরব ভূমিকা পালন করে, তাই এটি ছিল আওয়ামী লীগের জন্য শক্তি পরীক্ষা।

৭ জুনের হরতাল দমনে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। তা সত্ত্বেও সমগ্র প্রদেশ জুড়ে হরতাল পালিত হয়। কলকারখানা, দোকানপাট, গাড়ির চাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, যেখানে জনগণের পুঞ্জিভূত বিক্ষোভ হরতালের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। পিকেটিং ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ হরতাল মানুষের অধিকারকে সমুন্নত রাখার বিদ্রোহী মনোভাবকেই প্রকাশ করেছিলো। আগের আন্দোলনগুলোতে ছাত্র সমাজ অংশ নিলেও এ আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ৭ জুনের এ হরতালে ঢাকা, টঙ্গি ও নারায়ণগঞ্জে সরকারি ভাষ্যমতে এগারোজন নিহত হন। কিন্তু একদিনে এত লোক আগে কখনো মারা যায়নি। নিহতদের মধ্যে মনু মিয়া আর আবুল হোসেন ছিলো যারা সাহস নিয়ে ইপিআরের সামনে গিয়ে বুক পেতে দেন আর তারা তাদের বুকেই গুলি করে। তাদের মৃত্যুতে ছাত্র জনতা তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে যায়। সার্বিকভাবে এক বিপ্লবী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একদিনেই গ্রেফতারের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে যায়। সন্ধ্যায় শ্রমিক এলাকাগুলোতে কারফিউ জারী করা হয়। অপরদিকে, হরতালের দিন ৭ জুন পুলিশ ইপিআর এর গুলিবর্ষণ ও মানুষ হত্যা সম্পর্কিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলের মূলতবী প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে সদস্যরা প্রতিবাদে ওয়াকআউট করেন। আন্দোলনের তীব্রতা জুন মাসের পরেও চলতে থাকে, সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় দফায় সারাদেশে গ্রেফতার করা হয় ৯৩৩০ জন নেতা কর্মীকে কিন্তু এর পরেও ৬ দফা আন্দোলন দমানো যায়নি।

৬ দফা আন্দোলন নস্যাত করে দেয়ার উদ্দেশ্যে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামী করে আইয়ুব সরকার ১৯৬৮ সালে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ উল্লেখ করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। মূলত ৬ দফার ধারাবাহিকতায় আগরতলা মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ চলে আসে, যা একইসুত্রে গাঁথা। তাই ৬ দফার গুরুত্ব একেবারেই হালকা করে দেখার মত নয়। বলা যায় পাকিস্তান সরকারের মূর্ত আতংক ছিলো এই ৬ দফা। একে কেন্দ্র করে ৭ জুনের গণবিক্ষোভ বাংলার মুক্তিকামী জনতার প্রতিবাদী বহিঃপ্রকাশ।

বাঙালির জীবনে ১৯৬৬ সাল এবং তৎপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ অবধি সময় জাতীয় চিন্তার স্ফুরণ এবং মুক্তির ইতিহাস। ৬ দফা কেন্দ্রিক ৭ জুনের আন্দোলনের পথ ধরে ৭১ এ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। তাই এই তারিখটি ঐতিহাসিকভাবেই স্মরণীয়। ৬ দফা অতিদ্রুত বাঙালির জাতীয় মুক্তির চেতনামূলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে সংঘটিত হয় বাংলাদেশ বিপ্লব, ১৯৭১। হাজার বছরের আন্দোলনসংগ্রামের পটভূমিতে সে ইতিহাস রচিত। ৬৬ র ৬ দফায় প্রকাশিত জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং এর কেন্দ্রিকতায় ৭ জুনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুথানে গণবিদ্রোহ, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় মুক্তির ইস্যুতে আওয়ামী লীগের গণম্যান্ডেট লাভ, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, এ সবই মুক্তির সোপানে উজ্জীবিত হওয়ার উদাহরণ। লেখক: প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বাস করতে হয় তুমি নেই
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের যানবাহনের একাল-সেকাল