৫৬৯৭ জন গ্র্যাজুয়েট পেলেন সনদ

প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ৩য় সমাবর্তন ।। শিক্ষা মানে মনোজাগতিক উন্নয়ন : শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল প্রকৃতিই আমাদের বড় শিক্ষক : পবিত্র সরকার

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাই রে/ কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাই রে। অনেক আগে সুনির্মল বসু তাঁর কবিতায় প্রকৃতির কাছে’ শিক্ষা গ্রহণের কথা বলে গেছেন। শুধু সুনির্মল বসু নন, আরো অনেকেই প্রকৃতির কাছে শিক্ষা নেয়ার কথা বলেছেন। সে অর্থে বলা যায়, প্রকৃতিই আমাদের বড় শিক্ষক।’ প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ৩য় সমাবর্তনে এসব কথা বলেছেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফেসর ড. পবিত্র সরকার। গতকাল নগরীর নেভি কনভেনশন হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন, প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ চন্দ ও প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. কাজী শামীম সুলতানা, ট্রেজারার প্রফেসর একেএম তফজল হক, পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, উপ-উপাচার্য প্রফেসর বেনু কুমার দে, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর সেলিনা আক্তার প্রমুখ।

সমাবর্তনে মোট ৫ হাজার ৬৯৭ জন গ্র্যাজুয়েটকে তাদের শিক্ষা সমাপনী সনদ তুলে দেয়া হয়। কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করায় সমাবর্তনে তানভীর মাহবুব (ব্যাচেলর অব সোশ্যাল সায়েন্স ইন ইকোনমিঙ), মো. মহিউদ্দিন ইকবাল (ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), সৈয়দা আফরোজা (ব্যাচেলর অব ল’জ), সোহানা সুলতানা (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), নাবিল সাদ (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), রিদওয়ানুল আহসান নাঈমকে (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডিমিনিস্ট্রেশন) চ্যান্সেলরস গোল্ড মেডেল; তাহমিনা নাজনীন (ব্যাচেলর অব আর্টস ইন ইংলিশ), ইউসরা আমরিন হুসেইন (ব্যাচেলর অব সোশ্যাল সায়েন্স ইন ইকোনমিঙ), শাহারিয়া জান্নাত সাফা (্‌ব্যাচেলর অব ল’জ), অভিজিৎ পাল (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), রাবিয়া জাহান নিশা (মাস্টার্স অব ল’জ), সুজয় বড়ুয়াকে (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গোল্ড মেডেল এবং তূর্ণা দেব (ব্যাচেলর অব ল’জ), মরিয়ম বেগম (ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), মো. রিদওয়ান সিদ্দিকী ওয়াদুদ (ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), সুলতানা আফরিন (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), জয়া সাহা (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), মো. সাইফুল ইসলামকে (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ভাইস চ্যান্সেলরস গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়। এছাড়া ১৮ জন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও ১৩ জন পোস্ট গ্র্যাজুয়েটকে প্রদান করা হয় ডিনস অ্যাওয়ার্ড।

বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, শিক্ষা শুধুমাত্র কোনো সনদ নেওয়ার প্রতিযোগিতা নয়, কর্মজীবনের জন্য একমাত্র উদ্দেশ্যও নয়। প্রাথমিকভাবে যে বিষয়টি শিক্ষার মাধ্যমে, বিশেষত, উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে লাভ করি, সেটা হচ্ছে আমাদের মনোজাগতিক উন্নয়ন। এর জন্য দরকার মনোজাগতিক পরিবর্তন, নৈতিকতার পরিবর্তন ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন। এই তিনটি বৈশিষ্ট্য আমাদের দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষে যদি না আসে, তাহলে ধরে নিতে হবে শিক্ষাটা সত্যিকার অর্থে বৃথা ছিল। গ্র্যাজুয়েট যারা আজকের সমাবর্তনে উপস্থিত আছেন সকলের উদ্দেশ্যে আমাদের নিবেদন হচ্ছে, আমরা দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষেও সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনগুলোকে গ্রহণ করে পুরো জীবনব্যাপী শিখে যাব।

তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হচ্ছে, লাইফ লং লার্নিং এবং লার্নিং হাউ টু লার্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েছি বলেই অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কর্মরত অবস্থায় যারা আছেন, তাদের কাজের উন্নয়নে, পেশার উন্নয়নে, বৃত্তির উন্নয়নে সার্বিকভাবে অনেক কিছু শিখতে হচ্ছে। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে অনুরোধ থাকবে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করার দক্ষতা ও বৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। তা না হলে যে কোনো পেশায় আমরা যাই না কেন, যে কোনো বৃত্তিতেই যাই না কেন, জীবন ধারণ করা ও কর্ম সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। উচ্চশিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা ইতোমধ্যে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োগ করতে যাচ্ছি। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে আমরা এই পলিসি বাস্তবায়ন করছি।

শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য শুধু আউটকাম বেইসড কারিকুলাম নয়, এডুকেশনের ইউনিফর্মটিও প্রয়োজন। ভাষাদক্ষতা ও বিভিন্ন ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সেল থাকতে হবে। এটা আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা। জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে মৌলিক বিয়ষগুলোর মানোন্নয়নে যে রূপরেখা (ডেল্টা রূপরেখা) দিয়েছেন, তা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। গ্র্যাজুয়েটদের এই রূপরেখা বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করতে হবে।

সমাবর্তন বক্তা প্রফেসর ড. পবিত্র সরকার বলেন, আমরা কি কেবল স্কুল-কলেজেই শিখি? আমাদের শিক্ষা শুরু হয় কি একটা নির্দিষ্ট বয়সে, রাষ্ট্র বা সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া ঘরে, নির্দিষ্ট জীবিকার মানুষদের কাছে? সবাই জানি, তা হয় না। আমি ভাষাবিজ্ঞানে সামান্য পড়াশোনা করেছি, শিশু যখন তার সাত মাসের শরীরে মায়ের পেটে অবস্থান করছে, সে তখনই মায়ের গলার স্বর অন্যদের গলার স্বর থেকে আলাদা করতে পারছে। সেটা হয়তো তার প্রথম শিক্ষা। জন্মের পর থেকে তার তুমুল শিক্ষা শুরু হয়ে যায়। এক হলো সামাজিক, শারীরিক শিক্ষা। মাকে সে সকলের থেকে আলাদা করে চেনে, সেই সঙ্গে অন্যদেরও আলাদা করে। তারপর আঠারো সপ্তাহ থেকে শুরু হয় তার ভাষা শিক্ষা। সে আর এক কঠিন সাধনা। কিন্তু কী আশ্চর্য ঘটনা, তিন সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সে অনর্গল বলতে শুরু করে সেই ভাষা, দশ বছরে তার ব্যাকরণ পুরো আয়ত্ত করে ফেলে। চমস্কি এটাকে মানুষের একটা কঠিনতম বৌদ্ধিক অর্জন অর্থাৎ শিক্ষা বলেছেন, তা শিশু করে ফেলে নিজের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে। অর্থাৎ সে যে একটা কিছু শিখছে তা সে বুঝতেই পারে না। অথচ পরে আমরা তো দেখি, একটা নতুন ভাষা শিখতে আমাদের কী গলদঘর্ম হতে হয়।

তিনি বলেন, তারপর বাড়িতে শিখি, মা আমাদের প্রথম শিক্ষক। তখন চারপাশে প্রচুর শিক্ষক জুটে যায়, তারা আমাদের স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ-নির্দিষ্ট শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দেন, সেই শিক্ষকেরা আমাদের পরীক্ষার সমুদ্র পার করে দেন। তারপর এই সমাবর্তন আসে। সমাবর্তনের পর আবার আমরা পৃথিবীর খোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাই। এখানে পাঠ্যবই নেই, রেফারেন্স বই নেই, আছে এক বিশাল ক্লাসঘর, আর অজস্র পরীক্ষা। আমি আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মতো জীবনের সব পরীক্ষায় তোমরা সহজে পাস করে যাও, তোমাদের অভিভাবক আর শিক্ষকদের মুখ উজ্জ্বল করো। নিজের কাজে সাফল্য অর্জন করে সমাজকে সমৃদ্ধ করো।

স্বাগত বক্তব্যে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, একটি শিশু জন্মগ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে। তোমরা স্কুলে ও কলেজে ছিলে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছ। এখন বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শেষ করে সমাবর্তনে উপনীত হয়েছ। এই দিনটি শিক্ষার্থীদের জন্য গর্বের দিন, আনন্দের দিন। এই দিন কেউ ভোলে না।

বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তা আছে, উদ্ভাবনী ক্ষমতা আছে। মানুষ পরিকল্পনা করতে পারে, চিন্তাকে এগিয়ে নিতে পারে। এ কারণে মানুষ নিজের স্বপ্নকে পূরণ করতে পারে। আজকের গ্র্যাজুয়েটদেরও অনেক স্বপ্ন আছে। দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে তারা অবশ্যই তাদের স্বপ্ন সফল করতে পারবে। তিনি বলেন, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে বাংলাদেশ এখন উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে জবাবদিহিতামূলক পদ্ধতির রূপরেখা সমন্বিত করার চেষ্টায় আছে। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল ইতোমধ্যে পড়ানো এবং কী পড়ানো হলো, কতটুকু অগ্রগতি হলো, একটি ক্লাস থেকে পরবর্তী ক্লাস পর্যন্ত, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক যৌক্তিক ও যথাযথভাবে পালিত হয়েছে কিনা, এইসব তদারকি করার কারণে একেকটি কেন্দ্র হয়ে পড়েছে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়।

পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিবেশনা শুরু হয়। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি সাংস্কৃতিক দল তাদের পরিবেশনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুকে গাছে বেঁধে মারধর করা হল মাথা ন্যাড়া
পরবর্তী নিবন্ধক্ষমা চাওয়ার শর্তে ৫ ছাত্রলীগ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত