১৬৫ বছরের পুরনো সমস্যা জলাবদ্ধতা

মোরশেদ তালুকদার | রবিবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

জলাবদ্ধতা। শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরের দুর্বল ড্রেনেজ সিস্টেম বা জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা এ জন্য দায়ি। বিগত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে গণমাধ্যমে খুব জোরালোভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে সমস্যাটি। বর্তমানে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নাগরিকগণ ক্ষু্‌ব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান এ বিষয়ে। এতে মনে হতে পারে, মাত্র কয়েক দশক ধরেই বোধ হয় জলাবদ্ধতার তীব্রতা বেড়েছে বা জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে। বাস্তবে এমনটি ভাবা ভুল। কারণ, ১৮৫৬ সালে চট্টগ্রাম শহরের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে অন্যতম ‘গুরুতর সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ওই হিসেবে ১৬৫ বছর ধরে দুর্বল ড্রেনেজ সিস্টেমের কারণে জলাবদ্ধতাজনিত সমস্যায় ভুগছেন শহরের বাসিন্দারা।
গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ’সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৮৫৬ সালে চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও শহরের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে গঠন করা হয় ‘কমিটি ফর দি স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দি টাউন অব চিটাগাং’ নামে একটি। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৯ জন। কমিটির প্রথম সভা হয়েছিল একই বছরের ১৪ মে। পরবর্তীতে ১৮৬২ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১০০ সভা হয়েছিল। প্রথম সভার কার্যবিবরণী বলা হয়েছে, ‘শহরের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল অন্যতম সমস্যা। শহরের লোকজন যেখানে বসবাস করে সেখানে এ সমস্য ছিল গুরুতর।’ সমস্যাগুলোর সমাধানে সভায় শহরের খাল-নালার উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। এজন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি উপ-কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তাছাড়া শহরের জমি ও খাল-নালার তুলনামূলক উচ্চতা নির্ধারণের জন্য ‘মেসার্স জার্ভিস অ্যান্ড রাসেল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
‘কমিটি ফর দি স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দি টাউন অব চিটাগাং’ এর প্রথম সভার কার্যবিবরণী পাঠানো হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলা সরকারের সচিবের নিকট। সেখানে বলা হয়, ‘প্রধান খালগুলোর পাড়ে প্রয়োজনমত পাকা বাঁধ দেওয়া ও পুল স্থাপন করা নির্ভর করছে ‘মেসার্স জার্ভিস অ্যান্ড রাসেল’ এর জরিপের উপর। জরিপ করার জন্য টাকাও বরাদ্দ চাওয়া হয়। তবে যেখানে দ্রুত জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা দরকার তা নিরসনে ইতোপূর্বে গঠিত উপ-কমিটি প্রথম কাজ শুরু করতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত অর্থ সংস্থান না হওয়ায় ‘মেসার্স জার্ভিস অ্যান্ড রাসেল’ জরিপ কাজ করতে পারে নি।
পরবর্তীতে ‘রিভেট’ নামে একজন সার্ভেয়ারকে ৩০০ টাকা পারিতোষিকে জরিপ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি ১৮৫৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শহরের আনুভূমিক উচ্চতার রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। এ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে রিভেটকে শহরের জল নিষ্কাশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য, ওই সময়ে চট্টগ্রাম শহরে অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া ছিল। যার বেশিরভাগ খালে পরিণত হয়ে মিশেছিল কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে। জোয়ারের সময় এসব খাল দিয়ে শহরে প্রবেশ করত লোনা জল।
ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান
‘কমিটি ফর দি স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দি টাউন অব চিটাগাং’ এ গৃহীত পদক্ষেপের ১৩৯ বছর পর ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম শহরের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার বিষয়টি আবারো জোরালো আলোচনায় আসে। ১৯৯৫ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষে ইউএনডিপি ও ইউএনএইএস এর সহায়তায় প্রণীত হয় ২০ বছর মেয়াদী ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান। যা ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। মাস্টার প্ল্যানে জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু সুপারিশ ছিল। যা গত ২৬ বছরে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে অল্প বৃষ্টিতে এখনো জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছেন নগরবাসী।
মাস্টার প্ল্যানের উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, শহরে বিদ্যমান খালগুলোর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তা দূর করা। পাশাপাশি নতুন খাল খনন, পুরাতন খালের গভীরতা বৃৃদ্ধি ও প্রশস্থকরণসহ সংস্কারকরণ, পাহাড়ের পলিমাটি ধারণের জন্য সিল্টট্রাপ নির্মাণ, নগরে অতিরিক্ত পানি ধারণের জন্য জলাধার নির্মাণ, জোয়ারের সময় নদীর পানি শহরে ব্যাক ফ্লু না করার জন্য জোয়ার নিয়ন্ত্রক (টিডাল রেগুলেটর) এবং নদীর উভয় তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা। অবশ্য বর্তমানে নগরে চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর আওতায় মাস্টার প্ল্যানের অনেকগুলো সুপারিশ পূরণ হতে পারে। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে দীর্ঘ ২৫ বছরে লাগবে কেন?
তাছাড়া যে সময়কে বিবেচনা করে মাস্টার প্ল্যান প্রণীত হয়েছিল তা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে বৈশ্বিক প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যার প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম শহরেও। যেমন প্রতি বছর বাড়ছে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা। যা শহরে জলাবদ্ধতার জন্যও দায়ি। যেমন ভারী বৃষ্টি না হলেও আগ্রাবাদসহ শহরের অনেকগুলো এলাকা তলিয়ে যায় জোয়ারের পানিতে। যা স্মরণ করিয়ে দেয় ১৮৫৬ সালে জোয়ারের পানিতে শহরে লোনা জল প্রবেশের বিষয়টি।
জলাবদ্ধতার কারণ
২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের পানি নিষ্কাশনে বিদ্যমান ১৬১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৩৮টি খালের পানি ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে ১০ কোটি ঘনফুট। পক্ষান্তরে প্রতি দেড় ঘন্টায় দেড় ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হলে আনুমানিক ১৪ কোটি ৫৮ লক্ষ ঘনফুট পানি হয়। যা স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি। ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে।’
একই প্রতিবেদনে জলাবদ্ধতার জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। যেমন শহরের নিম্নাঞ্চলসমূহ গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। বিপরীতে স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা ৩ দশমিক ৫ মিটার থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্ষাকালে পার্ণিমা অথবা অমাবস্যার জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত উঠে। যা শহরের নিমাঞ্চল থেকে ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ মিটার উঁচু। প্রকৃতিগত পানির এ উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে নগরীর নিম্নাঞ্চলসমূহে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শহরের খালগুলোর ওইসময়ের অবস্থা জানতে চেয়ে সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনের কাছে একটি চিঠি পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘মহানগরীর খালগুলো দখল করে প্রভাবশালী মহল অবৈধ স্থাপনা, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করায় চট্টগ্রাম শহরে মারাত্মক জলাবদ্ধতা হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে।’
এর বাইরে অপকল্পিত নগরায়ণ ও শহরের বালিমিশ্রিত পাহাড়ও জলাবদ্ধতার জন্য দায়ি। যেমন নগরের মোট আয়তনের ৪৭ শতাংশ পাহাড়ি ভূমি। এখানকার অধিকাংশ পাহাড় বালিমিশ্রিত। অতি বৃষ্টির সময় বালি মিশ্রিত পানি এসে খাল-নালাসমূহ ভরাট করে ফেলে। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য, শহরের আয়তন ১৫৫ দশমিক ৪ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাহাড়ি ভূমির আয়তন ৭৪ বর্গ কিলোমিটার।
অবশ্য ১৯৯৫ সালের মাস্টার প্ল্যান বিশ্লেষণ করলে শহরের এলাকাভিত্তিক জলাবদ্ধতার কারণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন বিদ্যমান কালভার্টের কম প্রশস্ততা এবং সদরঘাট খালের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণেই জুবিলী রোড, রিয়াজুদ্দিন বাজার এবং সদরঘাট এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। চাক্তাই খালের অপ্রশস্ততা এবং অগভীরতার কারণে চকবাজার, দেওয়ানবাজার, জামালখান, স্টেডিয়াম এলাকা, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়ে থাকে। লালখানবাজার, ষোলশহর, মেহেদীবাগ, নাসিরাবাদ, পাঁচলাইশ, শুলকবহর ও বহাদ্দারহাট এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার জন্য দায়ি হিজরা খাল, মির্জা খাল এবং বাকলিয়া খাল। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, পাঠানটুলী, মাদারবাড়ি, মোগলটুলী, মাঝিরঘাট এবং ঢাকা ট্রাংক লেইন এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য মোগলটুলী খাল, নতুন বাজার খাল, মহেশখাল এবং পশ্চিম মাদারবাড়ি থেকে স্ট্র্যান্ড রোড পর্যন্ত ঢাকা ট্রাংক লেইন খালের অপ্রশস্ততা দায়ি। লালখান বাজার থেকে বহাদ্দারহাটের জলাবদ্ধতার জন্য দায়ি মির্জা খাল, চশমা খাল ও চাক্তাই খাল। ফয়’স লেক, বায়েজিদ বোস্তামী অঙিজেন, চান্দগাঁও, কালুরঘাট, খাজা রোড সংলগ্ন বাকলিয়া এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য শীতল ঝর্ণা ছড়া খালের অপ্রশস্ততা দায়ি। প্রসঙ্গতঃ নগরে মোট ৫৭ টি খাল আছে।
জলাবদ্ধতার সাম্প্রতিক চিত্র
সিটি কর্পোরেশনের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের মোট আয়তনের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। যা আয়তনের দিক থেকে এক হাজার ৫৬ দশমিক ৬ হেক্টর বা ১০ দশমিক ৫৬৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে আগ্রাবাদ এলাকার ১৬৮ দশমিক ৯ হেক্টর, হালিশহরের ৩৪৫ হেক্টর, দক্ষিণ বাকলিয়ার ১৯৩ দশমিক ২ হেক্টর, মুরাদপুরের ১৭২ হেক্টর, চকবাজারের ১০৪ দশমিক ৪ হেক্টর এবং পূর্ব বাকলিয়ার ৭২ দশমিক ৯ হেক্টর এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। তবে ওই প্রতিবেদনের পরবর্তী পাঁচ বছরে শহরে জলজট বা জলাবদ্ধতা হয় এমন এলাকা বেড়েছে।
গত মার্চ মাসে প্রকাশিত পরিকল্পনা কমিশনের ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এর গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দিনে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলেই চাক্তাই খালসহ আশপাশের খালে পানির উচ্চতা ৪ দশমিক ১ মিটার বেড়ে যায়। এতে প্রধান সড়কে ১ মিটারের উঁচু পানি জমে যায়। জোয়ার হলে তা আরও বাড়ে।
চলতি বছরের ৬ জুন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত তিন ঘন্টায় ৪৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এর প্রভাবে তীব্র জলাবদ্ধতা হয়েছে নগরে। এদিন ছয় ঘন্টারও অধিক সময় পানিবন্দী ছিলেন নগরবাসী। এছাড়া ৩০ জুন দুপুর ১২ টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘন্টায় ৮৪ দশমিক ১ মিলিমিটার, ১ জুলাই ৬৩ মিলিমিটার এবং ৫ আগস্ট ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেও তীব্র জলাবদ্ধতা হয়েছিল নগরজুড়ে। গত ২৮ জুলাইও জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন নগরবাসী। এর আগে ১৪ মে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন মাত্র দেড় ঘন্টার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ তীব্র হয়েছিল নগরবাসীর। ওইদিন পৌনে ১০ টা থেকে শুরু হয় ভারী বৃষ্টি। যা প্রায় সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, সাম্প্রতিক বর্ষণে শহরের এমন অনেকগুলো এলাকায় জলাবদ্ধতা হয় যেখানে আগে কখনো হয়নি। যেমন ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের বেশ কিছু এলাকায় এবার জলাবদ্ধতা হয়েছে যেখানে এর আগে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলজট হয়েছিল।
জলাবদ্ধতায় ক্ষয়ক্ষতি
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, জলাবদ্ধতার কারণে ৮০ দশমিক ২৭ শতাংশ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে দুর্ভোগের শিকার হন। এছাড়া ৫৪ দশমিক ৩২ শতাংশের প্রাত্যহিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে, ৩১ দশমিক ৮৯ শতাংশের সময়ের অপচয় হয়েছে। একইসঙ্গে ২০ দশমিক ৮১ শতাংশের ব্যবসায়, ১৮ দশমিক ১১ শতাংশের আর্থিক এবং ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশের সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশের। এমনকি দুই দশমিক ৯৭ শতাংশ অসুস্থ হয়েছেন বা শারীরিকভাবে আঘাত পেয়েছেন জলাবদ্ধতার কারণে।
এর আগে প্রকাশিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলাবদ্ধতায় শহরের তিন লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়। গত মার্চ মাসে প্রকাশিত পরিকল্পনা কমিশনের ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এর গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে জলাবদ্ধতায় চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জে দুই হাজার ৫১৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরাসরি এই ক্ষতি হয়েছে পাঁচ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীদের দাবি, ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও কোরবানিগঞ্জে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে ও অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। জলাবদ্ধতায় অনেক ব্যবসায়ীর গুদাম পরিত্যক্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ক্ষতি এড়াতে খাতুনগঞ্জের ব্যবসার ৫০ শতাংশ এখন অন্যত্র চলে গেছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব কার
স্থানীয় সরকার আইন (সিটি কর্পোরেশন) ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিলে শহরের ‘পানি নিষ্কাশন’ ব্যবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘কর্পোরেশন নগরীতে পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন নর্দমার ব্যবস্থা করবে এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্য ও সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে নর্দমাগুলি নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করবে এবং পরিষ্কার রাখবে’। একই তফসিলে এটাও বলা হয়েছে, ‘নগরীতে অবস্থিত সকল বেসরকারি নর্দমা কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শনাধীন থাকবে এবং কর্পোরেশন প্রবিধান অনুযায়ী নর্দমার সংস্কার করার, পরিষ্কার করার এবং বন্ধ রাখার নির্দেশ দিতে পারবে’।
অর্থাৎ স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী, পানি নিষ্কাশনে প্রকল্পও গ্রহণ করতে পারবে সিটি কর্পোরেশন। আইনটির তৃতীয় তফসিলে ‘পানি নিষ্কাশন প্রকল্প’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কর্পোরেশন প্রয়োজনীয় বিবেচনা করলে বা সরকার নির্দেশ দিলে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে সুষ্ঠুভাবে পানি বা ময়লা নিষ্কাশনের জন্য সরকারি বা বেসরকারি খরচে নর্দমা নির্মাণ বা অন্যান্য পূর্ত কাজের জন্য পানি নিষ্কাশন প্রকল্প প্রণয়ন করতে পারবে।’
আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। বাস্তবতা হচ্ছে, জলাবদ্ধতায় নগর যখন ডুবে, ডুবেন নগরপিতাও। তাদের ডুবান নগরবাসী। কথা বলে ফেসবুক, গণমাধ্যম। কথা বলেন মেয়র ও তার দলের প্রতিপক্ষও। দুয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই নগরে জলজট হলে চুপ থাকে না কেউ। দুর্ভোগ নিরসনের প্রতিশ্রুতি জলের তলে হারিয়ে গেলে জলে ভাসে সমালোচনার নৌকা। যার প্রমাণ মিলে সিটি নির্বাচনেও। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ওই নির্বাচনের দুইদিন আগে ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গিযেছিল শহরের নিচু এলাকা। মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভরাডুবির কারণ হিসেবে তখন এ জলাবদ্ধতা আলোচনায় ছিল। এর পাঁচ বছর পর ‘জলাবদ্ধতা নিরসন’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র পদে বিজয়ী হন আ.জ.ম নাছির উদ্দীন।
অতঃপর আশার প্রদীপ
দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে নগরবাসীর কাছে এখন আশার প্রদীপ হয়ে আছে চারটি প্রকল্প। ১০ হাজার ৯২১ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে পৃথক প্রকল্পগুলো গ্রহণ করে সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সিডিএ’র মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এক হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। দুই হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ ২০ টাকায় ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এছাড়া এক হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরের বহাদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল নতুন খাল খননে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একটি প্রকল্প আছে।
অবশ্য বর্তমানে প্রকল্পগুলোর গড় অগ্রগতি হতাশাজনক। তাছাড়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যার কতটুকু সমাধান হবে সেটাও স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে গত জুন মাসে সিডিএ’র মেগাপ্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। নিরীক্ষার অংশ হিসেবে পরিচালিত এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মাত্র ৩০ শতাংশের ধারণা প্রকল্পটি বস্তবায়নের মাধ্যমে শহরের জলাবদ্ধতা সম্পূর্ণ দূরীভূত হবে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্দেহভাজন ৫ পরিকল্পনাকারীর বিচার এখনও ‘অনেক দূরে’
পরবর্তী নিবন্ধএলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : গতি আসুক নির্মাণ কাজে