হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সাহিত্য দলিল

শাকিল আহমদ | শুক্রবার , ৩ মার্চ, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতির প্রথম অর্জন ভাষা আন্দেলনের আয়ুষ্কালও প্রায় পৌনে এক শতাব্দী হতে চলেছে। এই দীর্ঘ সময়ে ভাষা আন্দোলনের অনুষঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের একটি ব্যাপক পরিসর গড়ে উঠেছে। মূলত একুশের সাহিত্য ধারায় ব্যাপক চর্চা শুরু হয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালে। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে গুটিকয়েক সাহসী শিল্পীদের কলমই কর্ষিত হয়েছে মাত্র এবং এদের অনেককেই নির্যাতন নিপীড়নও সইতে হয়েছে। একুশের প্রথম সাহিত্য সংকলন ছিল হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। প্রকাশকাল ১৯৫৩এর মার্চ। প্রকাশের কিছুদিন পরেই বইটি তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করে। অবশ্য, পরে ’৫৬ সালের দিকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনটি থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।

একুশের সাহিত্য ধারায় কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনটি এক ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। আজকের প্রজন্মের কাছে অতীব দুর্লভ এই মূল গ্রন্থটি কিংবদন্তির মতো সাহিত্যানুরাগীদের মুখেমুখে ভেসে বেড়ায় কিন্তু বাস্তবে খুব একটা চোখে পড়ে না। হাসান হাফিজুর রহমানের বন্ধু মোহাম্মদ সুলতানের উদ্যোগে পুঁথিঘর প্রকাশনি থেকে ’৫৩ সালে এটি প্রকাশিত হয়। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বইটি ক্রাউন সাইজে ১৮৩ পৃষ্ঠায় তৈরি হয়েছিল। প্রচ্ছদপট এঁকেছিলেন আনিসুল ইসলাম। রেখা অঙ্কন করেছিলে শিল্পী মুর্তজা বশীর ও অন্যান্য। লেখকদের তালিকাটা ছিল নিম্নরূপএকুশের প্রবন্ধ: একুশে ফেব্রুয়ারী, সকল ভাষায় সমান মর্যাদা: আলী আশরাফ; একুশের কবিতা: শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আব্দুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামাল উদ্দিন , আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান; একুশের গল্প: শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ,আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আতোয়ার রহমান; একুশের নকশা: মুর্তজা বশীর, সালেহ আহম্মদ; একুশের গান: আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন; একুশের ইতিহাস: কবির উদ্দীন আহমদ। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ স্মরণিকাটির বিশেষত্ব এই যে, সেদিন বাংলা সাহিত্যের বাইশ জন তরুণের প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে এই ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বইটি ছিল তারই বার্তাবহ। শুধুমাত্র বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার বহিঃ প্রকাশ নয়; শুধু শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়; বাংলাদেশকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প। শহীদের অসমাপ্ত কর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ ছিল এই ১৮৩ পৃষ্ঠার স্মরণিকাটিতে। যে ভাষায় এর ভূমিকা লেখা হয়েছে এবং এই বইয়ের ভিতরে যে প্রতিবাদমূলক ছবি ছাপা হয়েছে তা ছিল সে সময়ের এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ এবং দেশদ্রোহিতার শামিল। ভূমিকার অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো

রক্ত দিয়ে আমরা প্রতিটি হৃদয় এই আত্মদর্শনকে অর্জন করেছি, রক্তের অক্ষরে আমাদের প্রতিটি সাহিত্যিক এই মহাগাথাকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই সারাদেশে একুশের কাহিনি আবেগে অমোঘ, বিশ্বাসে অনন্য।

একুশের এই অনবদ্য স্মরণিকাটির ভেতরের লেখা এবং রেখা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যায়। প্রাবন্ধিক আলী আশরাফ তাঁর ‘সকল ভাষায় সমান মর্যাদা’ শীর্ষক দীর্ঘ ৮ পর্বের প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনার ঠিক এক বছর পর অর্থাৎ ৫৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে। সমকালিন পরিবেশের জন্য এটি ছিল প্রাবন্ধিকের এক অসাধারণ সাহসী উচ্চারণ। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে তিনি এখন পুরোপুরি অবিশ্বাসের চোখে দেখেন, তাদের দুরভিসন্ধির প্রতি সজাগ থাকতে বলেছেন। পক্ষান্তরে, তাদের দুর্বল চিত্রের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণও তিনি করেছেন প্রবন্ধটিতে। তিনি বলেছেন, ‘স্বৈরাচারী শাসক চক্রের এখন এসাহস নেই যে, প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারে, উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাই তারা চুপ করে আছে, এটা তাদের দুর্বলতার লক্ষণ’। প্রাবন্ধিক আশরাফের প্রবন্ধটিতে ভাষা আন্দোলনেরও ইঙ্গিত রয়েছে। একুশের কবিতায় এগারো জন কবির শিরোনামহীন এগারোটি কবিতা স্থান পেয়েছে। এই কবিতাগুলোর মধ্যে কয়েকটি আজ বাংলা সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ কবিতা। এই কবিতাগুলোতে একুশের অনুষঙ্গ বিচিত্র ধারায় ধরা পড়েছে। উপমা, রূপকউৎপ্রেক্ষায় কোন কোন কবিতা পেয়েছে আবহমান শিল্পরূপ। যেমন:

টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলো আমায় সূর্যের মত হৃৎপিন্ড,/ যেমন কোনো পেশওয়ারী ফলওয়ালা তার ধারালো ছুরির হিংস্রতায়/ ফালি ফালি করে কেটে ফেলে তাজা, লাল টকটকে একটি আপেল।/ কিন্তু শোনো, এক ফোঁটা রক্তও যেন পড়ে না মাটিতে। কেননা, আমার রক্তের কণায় কণায় উজ্জ্বল স্রোতের মতো/ বয়ে চলেছে মনসুরের বিদ্রোহী রক্তের অভিজ্ঞান। (শামসুর রাহমান।)

প্রয়াত ফজলে লোহানীর কবিতাটিতে ঘটনাবহুল একুশের বেদনাবিধুর দিনটির এক শৈল্পিক বর্ণনা ধরা দিয়েছে। একুশের সকালের ঘটনা

শহর, নগর, জনপদ পেরিয়ে বিকেল সন্ধ্যে হতে না হতে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নেমে আসে এক করুণ বিষাদের ছায়া। যেন নিরব নিথর পৃথিবী।

নোকার মাঝি হাল ছেড়েছে,/কামারের ঘরে হাপর থেমেছে

কাস্তে থেমেছে, কোদাল থেমেছে,/ রেল ইঞ্জিনে সিটি থেমেছে।

একুশের এক অসাধারণ সৃষ্টি আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতাটি। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ তে শিরোনামহীন তার এই উল্লেখযোগ্য কবিতাটিও স্থান পায় । কবি একুশের সকালে যে আন্দোলন তার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং ঢাকা মেডিকেলের সামনে ইটসুরকি দিয়ে প্রথম যে শহীদ মিনার রাতারাতি গড়ে উঠে তা পরদিন সকালে পুলিশ কর্তৃক ভেঙে ফেলার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন এবং এই ঘটনা কবিকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করে। সেইদিন রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এই অসাধারণ শিল্পকর্মটি রচনা করেন। সেইদিন তার সহযাত্রীদেরকে হারিয়েও তিনি বিচলিত হননি। ফেটে পড়েছে প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু,

আমরা এখনো সাড়ে চার কোটি পরিবার

খাড়া রয়েছি তো! যে ভিত কখনো কোন রাজন্য পারেনি ভাঙতে।

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর কবিতাটিতে ভাষা শহীদদের মাতৃভাষাকে নিয়ে যে লালিত স্বপ্ন ছিল তার বর্ণনার সাথে সাথে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে সন্তানের জন্য অপেক্ষমান মায়ের হাজারো আশা আকুতি যা আর কখনো পূরণ হবার নয়। চিঠির উত্তর আর মায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছেনি। তার পকেট ছিল ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা

মাগো ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে

তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না

বলো মা তা কি হয়?/ লক্ষী মা রাগ করো না

মাত্রতো আর ক’টা দিন

মায়ের কাছে যাবার ‘মাত্র আর ক’টা দিন’ আজো এল না, হয়তোবা মা আজো সেই পথপানে চেয়ে আছে। অনন্তকাল চেয়ে থাকবে ছেলের অপেক্ষায়।

হাসান হাফিজুর রহমানের দীর্ঘ কবিতাটিতে মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ অনুরণিত হয়েছে। এভাষার আড়ালে যে হারানোর বেদনা তা কবিকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করেছে। ‘আর একবার ডাকলে ঘৃণায় তুমি ফেটে উঠবেসালাম, রফিক উদ্দীন, জব্বার কি বিষন্ন থোকা থোকা নাম। এই একসারি নাম বর্শার তিক্ষ্ম ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে’।

একুশের অনুষঙ্গ বিভিন্ন আঙ্গিকে সবচেয়ে চমৎকারভাবে উঠে এসছে আমাদের কথাসাহিত্যে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ স্মরণিকাটিতে পাঁচটি গল্প রয়েছে। সবক’টি গল্পের বিষয়বস্তু উপস্থাপিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের আবর্তে। প্রথম গল্প শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’। গল্পের প্রেক্ষাপট কিন্তু আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা নয়। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান পেশাগত কাজে তখন চট্টগ্রাম অবস্থান করছেন। সঙ্গত কারণেই তার গল্পের বিষয়বস্তুও গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামকে ঘিরে। ঢাকায় যে ভাষার জন্য যুদ্ধ চলছে তার রেশ চট্টগ্রামে টেনে এনে তিনি এক চমৎকার গল্পের অবতারণা করেছেন। বায়োজিদ বোস্তান, নতুন পাড়া হয়ে বাস ছুটে চলেছে হাটহাজারীতে। এই বাসযাত্রীর আহাজারি নিয়েই গল্পের মূল বিষয়। বৃদ্ধটি আর কেউ নয়, সদ্য ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া এক সন্তানের পিতা। লেখক ভাষা আন্দোলনের বিষয়টিকে কৌশলে ঢাকাকেন্দ্রিক না রেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন গল্পটিতে।

সাইয়িদ আতীকুল্লাহ’র ‘হাসি’ নামের দুই পর্বের বড় গল্পটির প্রথম অংশটি বিস্তার লাভ করেছে আবুর প্রতি নাহার খালার পুত্রবৎসল মায়ামমতা এবং সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আবুর ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ এবং সেই চুড়ান্ত পরিণতির নায়ক আবু নিজেই। আবুর বন্ধুরা লাশ ঘরে রেখে চলে যায়। পরক্ষণে পুলিশ আবুর লাশ নিতে আসে। তখন নাহার খালার আকুতি– ‘ওকে নিয়ো না পরে এসে না হয় নিয়ে যেও। ও যে আমার হাসি দেখতে চেয়েছিল। আমার হাসি’। হাসি গল্পের নামকরণ এখানেই বিদ্যমান অর্থাৎ আবু সকালবেলা আন্দোলনে বেরিয়ে পড়ার সময় অভিমানি নাহার খালার মুখের হাসি ফিরে দেখার প্রতিজ্ঞা করে যায়, যা আর কখনো দেখবার নয়।

আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’ গল্পটি একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রাত্যহিক জীবন প্রবাহকে নিয়ে আবর্তিত। অবসরপ্রাপ্ত সাদত সাহেব, সালেহা, আসাদ, আসাদের সন্তান সম্ভবা বৌ এবং বিবাহযোগ্য কন্যা হাসিনাকে নিয়েই সাদাত সাহেবের হাসিকান্নার সংসারে গতিময়তা আসে। প্রতিদিনকার মতো আজও আসাদ সকালে অফিস চলে যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে লাশ হয়ে। ঘটনার নায়ক আসাদ ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয়কর্মী না হলেও ঘটনাচক্রে তিনি জীবন দিয়ে ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেলেন। স্বল্প পরিসরে গল্পকার অত্যন্ত সুনিপুনভাবেই ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই ‘দৃষ্টি’ গল্পটি দাঁড় করিয়েছেন। সিরাজুল ইসলামের ‘পলিমাটি’ গল্পটির কাহিনি গড়ে উঠেছে কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষ শক্তিকে নিয়ে। অর্থাৎ পুলিশী দমন নীতির কলাকৌশলের এক নিপুণ বর্ণনা রয়েছে। কাহিনির সময়কাল তেইশ এবং ছব্বিশে ফেব্রুয়ারী। স্বভাবতই তখন গোটা দেশ প্রচন্ড উত্তপ্ত। এমনতর একটি পরিস্থিতিতে ঝানু পুলিশ অফিসার জহির সাহেবও যে অনেক সময় গণ আন্দোলনের মুখে চুপসে যেতে বাধ্য হয়, তার একটি বাস্তব চিত্র ‘পলিমাটি’ গল্পে বিধৃত । গল্পটিতে লেখক কৌশলে সত্যকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রশাসনের রক্তচক্ষুর পরাজয় ঘটিয়েছে।

গল্পকার আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’ গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্রমনি। ছোট শহর থেকে মনি সপরিবারে একসময় উঠে আসে রাজধানীর বুকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের দূরন্ত সন্তান ক্রমাগত বেড়ে উঠা মনির জীবনে মা বাবা, বোন ছাড়াও আস্তে আস্তে নিকটে আসে কিশোরী স্ত্রী মাহবুবা এবং আরও পরে বন্ধু ইউসুফ। ইতোমধ্যে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিতে যাচ্ছে। ক্রমাগত ব্যস্ততাও বেড়ে যায় মনির। ‘আজ তারিখ একুশ আর আমার বয়সও এখন একুশ। দেখি কোন্‌ একুশ জিততে পারে’। শেষ পর্যন্ত মনিই ভাষার জন্য মরে জিতে গেলে। সবক’টি গল্পের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই এই ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচাইতে অগ্রণী ভূমিকাটি ছিলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির। আসলে বাস্তবে তাই। মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সাথে যুক্ত। সেটি শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলনে কেন? জাতীয় সব আন্দোলনে।

একুশের নকশাতে শিল্পী মুর্তজা বশীর লিখেছেন– ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরীর কয়েকটি পাতা’। বিশ, একুশ এবং বাইশফেব্রুয়ারীর বাস্তব ঘটনার একটি নিপুণ বর্ণনা রয়েছে মুর্তজা বশীরের নকশাটিতে। এটি পড়লে মনে হবে লেখক ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেই, উপরন্তু সমস্ত ঘটনাকে পর্যবেক্ষণও করেছেন গভীরভাবে। অপর একুশের নকশাটি সালেহ আহমেদের ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত স্বাক্ষর।’ এটিতেও স্বৈরাচারী শাসকচক্রের পুলিশের যে নির্মম আচরণ, ভাষা আন্দোলনের ঘটনার সময় চরিতার্থ হয়েছে তার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়।

একুশের গানে আবদুল গাফফার চৌধুরীর সেই অমর গাথা– ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/আমি কি ভুলিতে পারি’। এবং তোফাজ্জল হোসেনের রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি/ ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ এদুটি কালোত্তীর্ণ গান স্মরণিকাটিতে প্রথম স্থান করে নেয়।

হাসান হাফিজুর রহমান ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বইটিতে আরও সংযোজন করেছেন ‘‘একুশের ঘটনাপঞ্জী শিরোনামে ৩০ জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবেই ঘটে যাওয়া ২৭ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের উপর উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো। এই সংবাদগুলো পরিবেশন করছেন কবির উদ্দিন আহমদ।

হাসান হাফিজুর রহমান একুশে ফেব্রুয়ারী স্মরণিকাটিতে শুধু লেখার ক্ষেত্রে যে সাহসিকতা এবং নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তা নয়, লেখার সাথে সাাথে এখানে স্থান পেয়েছে কিছু রেখাচিত্রও। এই প্রতিবাদী চিত্রগুলো ছিল সেই সময়কালের জন্য অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ। সবক’টি গল্পের শেষ প্রান্তে এই প্রতিবাদ মুখর চিত্রগুলো স্থান পেয়েছে। এধরনের চিত্র আরও আছে একুশের নকশাগুলোতে। প্রতিটি চিত্রই যেন প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। সব মিলিয়ে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ স্মরণিকাটি আবেগেপ্রতিবাদে সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের এক অনবদ্য দলিল হয়ে ইতিহাসে সাক্ষ্য দেয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘বেস্ট সেলার কনসেপ্টটাই মিথ্যা’
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে জমিতে পড়ে ছিল যুবকের মরদেহ