‘বেস্ট সেলার কনসেপ্টটাই মিথ্যা’

| শুক্রবার , ৩ মার্চ, ২০২৩ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

তরুণ ঔপন্যাসিক মাহতাব হোসেন। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বেরিয়েছে তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস ‘সাতচল্লিশের ট্রেন’ (২০২৩)। এর আগে একে একে বেরিয়েছে বেজক্যাম্প হোটেলের মধ্যরাত (২০১৮), শর্মিলা (২০১৯), নগরে সমুদ্র (২০২০), সন্ধ্যার পরে (২০২১) ও দিলরুবা (২০২২)। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাজমুস সাকিব রহমান। আসুন আলাপে ঢুকে পড়ি

সাকিব: মাহতাব ভাই, আপনার নতুন উপন্যাস ‘ ‘সাতচল্লিশের ট্রেন’। আপনি তো সমকালীন বিষয় উপজীব্য করে গল্প লিখতেন। হঠাৎ পেছনে যাচ্ছেন কি?

মাহতাব: এটা একদম সমকালীন গল্প। বর্তমান সময়ের একজন চরিত্রের সঙ্গে ঘটনাক্রমে এক বৃদ্ধার সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি দেশভাগের দুর্দশার শিকার। স্বাভাবিকভাবেই পেছনের গল্পটা বর্তমান সময়কে স্পর্শ করেছে। সেই সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম দেশভাগের দুর্দশা উঁকি দিয়ে দেখার সুযোগ পাচ্ছে। গল্প এগিয়েছে ঠিক এই সময়কে সঙ্গে নিয়ে। যেহেতু এই সময়টা সাতচল্লিশকে টেনে এনেছে, তাই উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে দেশভাগ। এর আগেও আমি নব্বই দশকের গল্প লিখেছি, উপন্যাসটির নাম ‘শর্মিলা’; সেটা বেস্ট সেলার তালিকায় ছিল।

সাকিব: নতুন উপন্যাসের সংলাপে উর্দু ভাষার ব্যবহার আছে। এটা মেশালেন কীভাবে?

মাহতাব: আমি যে অঞ্চলে বড় হয়েছি সেখানে উর্দুর ব্যবহার বহুল। ফলে তাদের সঙ্গে মিশে এই ভাষা ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। আর আমি যা লিখতে চাই, যে পাঠককে দেখাতে চাই্ততা আমি নিজে আত্মস্থ করি, দেখি, তারপর লিখি। এই উপন্যাসে উর্দু সংলাপ যতটকু আছেও তাও বাংলার সঙ্গে মিশে এসেছে। ফলে পাঠকের কাছে সংলাপ দুর্বোধ্য লাগবে না।

সাকিব: ‘সাতচল্লিশের ট্রেন’ লিখতে গিয়ে তরুণ প্রজন্মের একজন হয়ে নতুন কোনো ইনসাইট পেলেন?

মাহতাব: দেশভাগের অজস্র গল্প রয়েছে। সেই গল্প নানা আঙ্গিকে নানাভাবে উঠে এসেছে। তবে আমরা দেশভাগের যেসব গল্প জানি তার অধিকাংশ এপার থেকে ওপারে চলে যাওয়া নিয়ে। আমার গল্প ওপার থেকে এপারে চলে আসার গল্প। এমন গল্প যে লেখা হয়নি তা নয়, তবে বাংলা সাহিত্যে সেটা খুবই কম হয়েছে। যদিও আমি যে জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লিখেছি, তাদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি একটা কাজ হয়নি।

ইতিহাসকে সে অর্থে না এনে আমি গল্পে দেখিয়েছি এই সময়েও যে দেশভাগের ক্ষত দগদগে হয়ে আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। ফলে বলা যেতে পারে এটা একদমই নতুন একটা দিক। যে সব পাঠক কঠিন বা জটিল বিষয়বস্তু এড়িয়ে চলেন, এটা তাদের জন্য সুখপাঠ্য হবে।

সাকিব: চরিত্রগুলো নিয়ে একটু বলেন। কীভাবে বেছে নিলেন এবং ঠিক করলেন ওই চরিত্রগুলো নিয়েই গল্প বুনবেন?

মাহতাব: উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তুহিন। তিনি ঢাকার গুলশানে বসবাস করেন। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় এটা এখনকার গল্প। তুহিনের চোখ দিয়ে উঠে এসেছে করোনাকালেরও কিছু অজানা চিত্র। বিপরীত দিকে ঢাকা থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে বসবাস করে বৃদ্ধা হুসনা বেগম। তিনি দেশভাগের করুণ পরিণতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়াও আইরিন এবং তনুশ্রী নামের দুই তরুণী রয়েছেন, রয়েছে তুহিনের গাড়ি চালক, বন্ধু ও তুহিনের আশ্রমের কর্মচারীরা। তুহিন যে জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন, সে অঞ্চলেই আমার বেড়ে ওঠা। বলতে পারো, ছোটবেলা থেকে তাদের দেখে দেখে বেড়ে ওঠা আমি যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন মনে হলো আমার দেখা গল্পগুলোই এই সময়ের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। এসব ভাবনাগুলো আমাকে ধীরে ধীরে প্লট তৈরি করে দিয়েছে।

সাকিব: ‘সাতচল্লিশের ট্রেন’ আপনার ষষ্ঠ উপন্যাস। গত ছয় বছর ধরে আপনি ধারাবাহিকভাবে উপন্যাস লিখছেন। আপনার উপন্যাস লেখার প্রক্রিয়াটা কি?

মাহতাব: উপন্যাস লেখার জন্য আমি সাবলীল ভাষা ও ভঙ্গিমা বেছে নিই। এতে একজন নতুন পাঠক সহজেই গল্পে ঢুকে যেতে পারেন। আরেকটা বিষয় হলো প্রচলিত জনরা ভেঙে ফেলা। যেমন, ‘সাতচল্লিশের ট্রেন’ উপন্যাসে চরিত্রগুলো সঙ্গে দেশভাগ উঠে এসেছে, একই সঙ্গে উঠে এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। এসব গল্প কিন্তু প্রবাহিত হচ্ছে বর্তমান সময়ের ধারায়। ঘটনাক্রমে রহস্যও যুক্ত হয়েছে। ফলে পাঠক গল্পের মাঝে মাঝে থ্রিলারের স্বাদ পাবে। অর্থাৎ বিরক্তির উদ্রেক হওয়ার আগেই দেখবে কয়েকটি বিষয় একই সড়ক ধরে সোজা সামনে চলে গেছে।

সাকিব: আপনার বইয়ের বিক্রি বেশ ভালো। বেস্ট সেলার লেখার টোটকা দিন।

মাহতাব: আমার বই কিছু মানুষ পড়ে এটা সত্য। তবে বেস্ট সেলার কনসেপ্টটা প্রায়ই মিথ্যা, যদিও আমি প্রথমে বলেছি আমার একটা বই বেস্ট সেলার তালিকায় ছিল। বিষয়টা একটু পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করছিবাংলাদেশে চলচ্চিত্র কেমন ব্যবসা করে সেটা বোঝার উপায় নেই। কেননা বাংলাদেশে বক্স অফিস নেই। যদি সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে এক্ষেত্রে আমরা সিনেমাটিকে হিট বলতে পারি। বাংলাদেশে বই বিক্রির বিষয়টাও তেমন। এক্ষেত্রে প্রকাশক ছাড়া এটা কেউই বলতে পারবেন না। প্রকাশকের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী আমরা বলতে পারি কোন বই কি পরিমাণ বিক্রি হয়েছে।

সাকিব: ঘটনাটা আরেকটু খুলে বলেন।

মাহতাব: বাংলাদেশে কিছু অনলাইন সংস্থা বই বিক্রি করে। শুধু অনলাইন মাধ্যমে বিক্রির হিসাবটা তারা দিতে পারে, মোট বিক্রির হিসাব তাদের কাছে নেই। তারা শুধু অনলাইন মাধ্যমে বিক্রি অনুযায়ী তালিকা তৈরি করে প্রকাশ করে, সেখানে মেলায় বিক্রি হওয়া বইয়ের হিসাব নেই। ফলে বেস্ট সেলার তালিকা আংশিক বইয়ের বিক্রির তালিকা। এক্ষেত্রে তুমি নিজেই বই বের করে অনলাইনে অর্ডার করে তাদের বেস্ট সেলার তালিকায় ঢুকে যেতে পারো।

প্রশ্ন করতে পারো তাহলে আমার বই বেস্ট সেলার তালিকায় এল কীভাবে? সেবার হয়তো ওই নির্দিষ্ট অনলাইন মাধ্যমে বেশি বই কিনেছিল। পরেরবার মোট বই বিক্রির হিসাবটা দীর্ঘ হলেও শুধু অনলাইন মাধ্যমে বিক্রি কম হওয়ায় তাদের তালিকায় ঢুকতে পারিনি। যেহেতু বাংলা একাডেমি কিংবা কোনো সংস্থা মোট বই বিক্রির কোনো জরিপ করে না, সেহেতু বেস্ট সেলার বলতে আদতে কিছু নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘নতুন প্রজন্মকে পতাকা উত্তোলন দিবসের ইতিহাস জানতে হবে’
পরবর্তী নিবন্ধহাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সাহিত্য দলিল