হাটহাজারীতে মুক্তিযোদ্ধার কবরের সাইনবোর্ড উধাও, বাঁধা আছে গরু

মো. আলাউদ্দীন, হাটহাজারী | বৃহস্পতিবার , ৫ জুন, ২০২৫ at ৯:৪২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম হাটহাজারী পৌরসভার মীরের হাট বাজারের পশ্চিমে রেললাইনের পাশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুলেটে শহীদ হওয়া এক অজ্ঞাতনামা ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থলের (কবরের) সাইনবোর্ড উধাও হয়ে গেছে।

বুধবার (৪ জুন) বিকেলে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ওই শহীদের সমাধিস্থলে লাগানো সাইনবোর্ডটির বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই এবং স্থানটিতে কোরবানির হাটের জন্য আনা গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। এর আগে সমাধিস্থলের আশপাশে বেশ কিছু দোকানও নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয়রা জানান, মীরেরহাটের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সংগঠন ‘ঝিনুক ক্লাব’-এর পক্ষ থেকে ওই অজ্ঞাত ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থলের পবিত্রতা রক্ষার জন্য “বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর, পবিত্রতা রক্ষা করুন” লেখা একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ক্লাবটি বিভিন্ন জাতীয় দিবসে, যেমন ১৬ই ডিসেম্বর, ২১শে ফেব্রুয়ারি ও ২৬শে মার্চ, ওই কবরে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাও জানাত। ঝিনুক ক্লাবসহ স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি হাটহাজারীতে শহীদ অপর একজন ইপিআর সদস্যসহ দুজনের কবর পাকা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা পরিষদে আবেদন করেও কোনো সাড়া পাননি বলে অভিযোগ করেন। তারা এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার সহযোগিতা কামনা করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও দোকানদার জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের (২০২৪) পর হঠাৎ করেই কে বা কারা ওই সমাধিস্থল থেকে সাইনবোর্ডটি সরিয়ে বা ফেলে দেয় এবং এরপর সমাধিস্থলের আশপাশে বেশ কয়েকটি দোকান নির্মাণ করা হয়। সাইনবোর্ড না থাকায় এবং স্থানটি অচিহ্নিত হয়ে পড়ায় কোরবানির হাটে গরু বিক্রি করতে আসা গ্রামের সাধারণ মানুষজন সমাধিস্থলের সামনে ও আশপাশে গরু বেঁধে রাখছেন, যা শহীদের প্রতি চরম অবমাননাকর।

উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক ও হাটহাজারী প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এইচ এম মনসুর আলীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অতর্কিতে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের ওপর নির্বিচারে গুলি শুরু করলে অনেকে শহীদ হন, তবে কেউ কেউ কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তেমনি একজন ইপিআর সদস্য পালিয়ে এসে ২৬ মার্চ দুপুরে হাটহাজারী উপজেলার মুন্সী মসজিদে সাদা পোশাকে জোহরের নামাজ আদায় করতে প্রবেশ করেন। কিন্তু নামাজ শুরুর আগেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি সাঁজোয়া দল মসজিদের সামনে এসে মুসল্লিদের তল্লাশি শুরু করে এবং ওই সাদা পোশাকধারী ইপিআর সদস্যকে শনাক্ত করে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাকে মীরের হাটের পশ্চিমে রেললাইনের পাশে নজব আলী রোডের ধারে গুলি করে হত্যা করে ফেলে রাখে।

ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাকিস্তানি বাহিনীর এক অফিসারের নির্দেশে স্থানীয় আনোয়ার ও আবু তাহের লেদুসহ আরও কয়েকজন মিলে রাস্তার পাশে আনোয়ারের ভোগদখলকৃত রেলওয়ের জমিতেই তাকে দাফন করেন। দাফনের সময় তার গায়ে “ইপিআর” লেখা গেঞ্জি দেখে তিনি যে ইপিআর সদস্য ছিলেন, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হন। সেই কবরটি এখনো সেখানে বিদ্যমান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা পাক্ষিক ‘উত্তর চট্টলার’ সম্পাদক ও প্রকাশক এবং হাটহাজারী প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাংবাদিক এম দিদারুল আলম দুলাল বুধবার সন্ধ্যায় এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “একজন শহীদের সমাধিস্থলের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলে সেখানে দোকান তৈরি করা এবং গরু বাঁধা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক কাজ। আমি ওই শহীদের সমাধিস্থলের পবিত্রতা রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”

অজ্ঞাত ওই ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থল থেকে সাইনবোর্ড উধাও হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহেদ আরমান বুধবার রাতে জানান, তিনি ছুটিতে থাকায় এ বিষয়ে অবহিত নন এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

পরে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, “বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানলাম, এটা খুবই দুঃখজনক। দ্রুত খবর নিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

স্বাধীনতা লাভের ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই অজ্ঞাত শহীদ ইপিআর সদস্যের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় মেলেনি বা তার খোঁজে কেউ আসেনি। স্থানীয় সচেতন মহল মনে করে, সম্মিলিত সামরিক বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে এই অজ্ঞাত শহীদের স্মৃতি রক্ষা এবং তার প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো সম্ভব হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপেকুয়ায় বিপুল ভেজাল ভোজ্য তেল জব্দ, আটক ২
পরবর্তী নিবন্ধযানজট এড়াতে কর্ণফুলী সেতুর টোলে আরও দুই লেইন চালু