হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতের মুখোমুখি
গোটা ইউরোপ এখন শীতের-চাদরে ঢাকা, বলা যেতে পারে ‘হাড় কাঁপানো ঠান্ডা’। ক্ষণিকের তরে যদি সূর্যের মুখ দেখা যায় সে সৌভাগ্যের ব্যাপার। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্যে ঘরে-ঘরে সারাদিন চলে ‘হিটার’। প্রকৃতির যখন এমন রূপ তখন ইউক্রেনকে ঘিরে ইউরোপের রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দিনদিন। ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের বিরাজমান দ্বন্দ চরম আকার ধারণ করছে। রাশিয়া একদিকে তার ‘পেশীশক্তি’ প্রদর্শনের জন্যে ইউক্রেন-সীমান্তে লক্ষাধিক নিজ সেনা মোতায়েন করেছে, পাশাপাশি দিচ্ছে সামরিক মহড়া। ন্যাটো এবং আমেরিকা এই বলে মস্কোকে হুশিয়ার করে দিচ্ছে যে কোন অজুহাতে রাশিয়া যদি ইউক্রেন দখল করে তাহলে তা সমস্ত শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা হবে। তাদের অভিযোগ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের লক্ষ্যে নানা অজুহাত সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করছে। তবে মস্কো এই সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন সরকারি মুখপাত্র বলেন, ‘রাশিয়া যদি এই ধরণের কিছু করে তাহলে ইউক্রেনবাসী নিজ দেশ রক্ষায় চরম ত্যাগ দিতে প্রস্তুত’। মার্কিন সরকারের অভিযোগ রাশিয়া ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর অর্থ হলো, মিথ্যে ক্ষেত্র বা অজুহাত তৈরী করে আক্রমন করা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মতে ইউক্রেন সীমান্ত অতিক্রম করাকে ‘জায়েজ’ করার জন্যে রাশিয়া সীমান্তে নিয়োজিত তার নিজ সেনাবাহিনীর উপর নিজেরাই আক্রমণ ঘটিয়ে দোষ চাপিয়ে দেবে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর উপর এবং সেই অজুহাত দেখিয়ে ঢুকে পড়বে ইউক্রেনে। এই অনুমানকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। যায় না, এই কারণে ২০১৪ সালে রাশিয়া এমনতর অজুহাতে ইউক্রেনের অধীনে থাকা উপদ্বীপ ক্রিমিয়া জোরজবরদস্তি নিজ দখলে নেয়।
ক্রিমিয়াকে ঘিরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরে। রাশিয়া দাবী করছিল এটি তাদের। অন্যদিকে ইউক্রেনিয়ানরা দাবি করছিল এটি তাদের। জাতিসংঘ এবং বিশ্বের অনেক দেশ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অধীন বলে ঘোষণা দিলেও রাশিয়া তা কখনোই মেনে নেয়নি। ক্রিমিয়া নিজ দখলে নেবার আগে রাশিয়া দাবি করে আসছিল যে ক্রিমিয়ায় বসবাসকারী সংখ্যালঘু রাশিয়ানরা ইউক্রেন সরকারের হাতে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে, তাদের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এক পর্যায়ে ২০১৪ সালে প্রো-রাশিয়ান মিলিশিয়া বাহিনী রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ক্রিমিয়া দখল করে বসে। তারপর সেখানে মস্কোর পরামর্শে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় যাতে ৯০% ভোটদাতা রাশিয়ার সাথে এক হয়ে যাবার পক্ষে তাদের রায় দেন। তবে সে গণভোট স্থানীয় অনেকেই বয়কট করেন। এখন ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল যদিও বা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ সহ বিশ্বের অনেক দেশ তা মানতে রাজি নয়। কিন্তু তাতে রাশিয়ার কী এসে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ‘হেন্‌ করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা’ বলে অনেক হুমকি-ধামকি দিয়েছিল, জারি করেছিল নানা অর্থনৈতিক অবরোধ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। রাশিয়া বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালো তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকা ও ইউরোপকে। পাঠকের সুবিধার জন্যে উল্লেখ করছি যে ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে ক্রিমিয়া একটি উপদ্বীপ বা পেনিনসুলা যা ব্ল্যাক সি (কৃষ্ণ সাগর) পর্যন্ত বিস্তৃত। মাত্র ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপদ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চাইতে সামান্য বড় এবং আলবেনিয়ার চাইতে সামান্য ছোট। এই উপদ্বীপটিতে যে ২০ লক্ষ অধিবাসী রয়েছে তার মধ্যে ৬০% রুশ-বংশোদ্ভূত, ২৫% ইউক্রেনীয় এবং ১২% ক্রিমিয়ান তাতার গোষ্ঠীর। রুশ ও ইউক্রেনীয়- দু ভাষাই এখানে প্রচলিত।

রাশিয়া কোনভাবেই চায় না ইউক্রেন ন্যাটো-জোটে যোগ দিক। তাহলে তা রাশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মস্কোর ধারণা। আর সে কারণে রাশিয়া ইতিমধ্যে দাবি করেছে তারা ইউক্রেনকে কোনভাবেই ন্যাটোর সদস্য হতে দেবেনা। রাশিয়া লিখিত আশ্বাসবাণী চায় যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো পূর্বদিকে (পূর্ব ইউরোপ) এগোবে না। ওয়াশিংটন রাশিয়ার এই দাবিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সম্ভাব্য ভবিষ্যতের আক্রমণাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ব্যাপারে এবং পূর্ব ইউরোপে মার্কিন ও ন্যাটো সামরিক মহড়ার উপর সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে মস্কোর সাথে আলোচনা করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে। এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সমপ্রতি বলেন, মস্কো তার নিরাপত্তার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সাড়া দেওয়ার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে প্রস্তুত নয়। তিনি আরো বলেন, মস্কো পশ্চিমাদের কাছ থেকে প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাবের প্রতিটি পয়েন্ট-বাই-পয়েন্ট সাড়া পেলে প্রেসিডেন্ট পুতিন তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ, কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্টের প্রভাষক আলেকজান্ডার টিটোভ মনে করেন, ‘এটি রাশিয়ার কৌশল। উত্তেজনা বাড়াতে, চাপ সৃষ্টি করতে এবং তার পক্ষে ইউরোপে একটি বিস্তৃত নিরাপত্তা স্থাপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করা’। রাশিয়া যে যড়যন্ত্র করে চলেছে তার প্রমাণ মেলে যখন গেল মাসে ইউক্রেনের সরকারী ওয়েবসাইটগুলি একটি বড় ধরনের সাইবার আক্রমণের শিকার হয়। সেখানে দেশের মন্ত্রিপরিষদের ওয়েবসাইট, সাতটি মন্ত্রণালয়, কোষাগার, জাতীয় জরুরি পরিষেবা এবং রাষ্ট্রীয় পরিষেবার ওয়েবসাইট, ইউক্রেনীয়দের ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট এবং টিকা সনদপত্র সংরক্ষণ করা হয়। ওয়েবসাইটগুলিতে ইউক্রেনীয়, রাশিয়ান এবং পোলিশ ভাষায় একটি বার্তা দেয়া হয় যাতে ইউক্রেনীয়দের ব্যক্তিগত তথ্য পাবলিক-ডোমেনে ফাঁস করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে ইউক্রেন সরকার এটি অস্বীকার করে বলেছে, কোনো ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়নি। কিয়েভের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষেবা শুক্রবার গভীর রাতে বলে, সাইবার আক্রমণে রাশিয়ার জড়িত থাকার লক্ষণ দেখা গেছে। অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেন, মস্কোর বর্তমান কার্যক্রম রাশিয়ার ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া (যা ১৯৫৪ সাল থেকে ইউক্রেনের অধীনে ছিল) অধিগ্রহণের সময় যা করেছিল তার অনুরূপ। মার্কিন এই সরকারি মুখপাত্র একে ‘নাশকতামূলক কার্যকলাপ’ ও ‘তথ্য অপারেশন’ হিসাবে অভিহিত করে তার এই আশংকা প্রকাশ করেন যে, ‘ইউক্রেনে একটি সম্পূর্ণ সামরিক আগ্রাসন জানুয়ারির মাঝামাঝি এবং মধ্য-ফেব্রুয়ারির মধ্যে শুরু হতে পারে’। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত ১৪ জানুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে। এক বার্তায় ইউনিয়ন বলে, ‘ইউক্রেন সরকারের ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে এই সাইবার-আক্রমণ অগ্রহণযোগ্য। এই ধরনের কর্মের লক্ষ্য ইউক্রেনকে অস্থিতিশীল করা এবং বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং এটি ইতিমধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির আরও বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে’। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি ইউক্রেনের সাথে যোগাযোগ করে চলেছে এবং এই সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিকার করতে ইউক্রেনকে অতিরিক্ত প্রত্যক্ষ,প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানানো হয়। ওই বার্তায় আরো বলা হয়, ‘আমরা আন্তর্জাতিকভাবে- স্বীকৃত সীমানার মধ্যে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি আমাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পুনঃনিশ্চিত করছি’। এই লেখা যখন লিখছি সেই মুহূর্তে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টোনি ব্লিনকেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ইউক্রেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেলেনস্কির সাথে এই বিষয়ে আলাপ শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন। ব্লিনকেন বলেন, রাশিয়ার অপতৎপরতার জন্যে ইতিমধ্যে ইউক্রেনে ১৪ হাজার লোক মারা গেছে এবং আরো অনেকে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে এবং তা রক্ষায় সকল সহযোগিতা দেবে। কিয়েভ থেকে ব্লিনকেন যাবেন জার্মানির রাজধানী বার্লিনে। সেখানে তিনি জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে ইউক্রেন-ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন।
এদিকে মস্কো ওয়াশিংটনকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দোরগোড়ায় সামরিক তৎপরতা বন্ধ না করে, তবে তারা ল্যাটিন আমেরিকায় সামরিক সরঞ্জাম ও সম্পদ পাঠানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দেবে না। কিউবা এবং ভেনিজুয়েলায় সম্ভাব্য রাশিয়ান সামরিক সরঞ্জাম ও সম্পদ মোতায়েনে মস্কোর এই হুমকিকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান কেবল ‘তর্জন-গর্জন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে উড়িয়ে দিলেও সার্বিক পরিস্থিতি যে শুভ নয় সে বলার অপেক্ষা রাখেনা। ইউক্রেনকে ঘিরে দুই পরাশক্তির এই মারমূখী অবস্থান বিশ্বের জন্যে যে কোনভাবেই মঙ্গল বয়ে আনবে না তাতে কোন সন্দেহ নেই। উত্তেজনা নয়, আলোচনার মাধ্যমে এতদ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা একান্ত জরুরি। সেটি কেবল এই অঞ্চলের জন্যে নয়, গোটা বিশ্বের জন্যে। কেননা ইউরোপের দোরগোড়ায় তেমন কিছু ঘটলে গোটা বিশ্বে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। আশা করি সব পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সুস্থ থাকুক
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক স্বপ্ন বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা : কতটা অগ্রসর হলাম আমরা