‘I believe in the fundamental truth of all great religions of the world. Yes I am, I am also a Musilm, a Christian, Buddhist, and a Jew’ অর্থাৎ ‘আমি বিশ্বের সমস্ত মহান ধর্মের মৌলিক সত্যে বিশ্বাস করি। হ্যাঁ আমি তাই, আমি একজন মুসলিমও, একজন খ্রিস্টান, একজন বৌদ্ধ এবং একজন ইহুদি’–মহাত্মা গান্ধী।
ধর্মীয় সমপ্রীতি, সহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে গান্ধীর এই উক্তিটি মনে এলো। দেশে এবারের দীর্ঘ দিনের (প্রায় দেড় মাস) অবস্থানে বেশ কিছু পরিবর্তন এবং তা ভালোর দিকে চোখে পড়লো। আমার এই দেখা অন্যের সাথে মিলে যাবে তেমনটি হয়তো নয়। কিন্তু আমার কাছে যা সুন্দর ঠেকেছে, কিংবা অসুন্দর, তাই তুলে ধরার প্রয়াস আজকের লেখায়। দূর থেকে অনেক কিছু সুন্দর ঠেকে, ভালো লাগে। কাছে এলে দূর থেকে সুন্দর– লাগা অনেক কিছু আবার ঠেকে। এর উল্টো দিকও আছে। দূর থেকে যা মন্দ ঠেকে কাছে এলে তা ভালো লাগে। এটি নতুন করে উপলদ্ধি করলাম এবার দেশে এসে। দেশের বাইরে যারা থাকেন তাদের অনেকের মাঝে এক ধরনের উন্নাসিতা লক্ষ্য করা যায়। দেশ প্রসঙ্গ এলেই তাদের প্রথম মন্তব্য– ‘আর বলবেন না ভাই, দেশ একেবারে যা তা। সবদিকে অনিয়ম, অব্যবস্থা’। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়। তবে ‘টু জাম্প টু এ কনক্লুশন’ বলে ইংরেজিতে একটা কথা আছে যার অর্থ, ভালো করে যাচাই না করে একটা মনগড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছানো।
এবার দেশের বেশ কটি স্থানে গেছি, অনেকের সাথে মিশেছি, অনেকের সাথে পরিচয় ঘটেছে, নিজ থেকে যেচে অনেকের কাছ থেকে কিছু কিছু বিষয় জানতে চেয়েছি। এই যেমন আজ দুপুরে ফোন করে কথা বললাম তিন পরিচিত ব্যক্তির সাথে। তারা সবাই যার যার পেশায় প্রথম সারির। তাদের একজন রাজনীতি করেন, একজন আইনজীবী, বাকি জন সাংবাদিক। তাদের তিন জনের কাছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানতে চেয়েছিলাম। আমি যা দেখেছি, আমার যা মনে হয়েছে এই স্বল্প অবস্থানে তার সাথে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু অভিন্ন বা ভিন্ন তা যাচাই করার চেষ্টা করেছি। আমার এই প্রায় দেড় মাস দেশে অবস্থানের সপ্তাহ দেড়েক ছাড়া বাকিটুকু কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক। এই শহরে আমার জন্ম, বেড়ে উঠা, লেখাপড়া এবং ঢাকা যাবার আগ তক বছর কয়েক সাংবাদিকতা। চট্টগ্রাম আমাকে টানে। চট্টগ্রাম আমার শেকড়। শেকড় যেমন কাঁদে জলকতার জন্যে, ঠিক তেমনি আমিও কাঁদি চট্টগ্রামের জন্যে, আক্ষরিক অর্থে। তাই চাটগাঁর ভালো কিছু দেখলে ভালো লাগে। ভালো লেগেছে যা তার অন্যতম হলো জামালখান এলাকার পরিবেশ। আগের চাইতে এই এলাকায় গাড়ি চলাচল বিরক্তিকরভাবে বেড়েছে বটে, কিন্তু ভালো লেগেছে যে পুরো রাস্তার পাশে ফুটপাতে তরুণ–তরুণীরা পাশাপাশি বসে, কেউ হাত রেখে, কেউ জটলা পাকিয়ে দুপুর–সন্ধ্যে বেলায় আড্ডা দিচ্ছে দেখে। বোরখা, হিজাব পড়া তরুণীর সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়। সন্ধ্যের দিকে চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাব, খাস্তগীর গার্লস স্কুলের পাশ ধরে হেঁটে গেলে বার কয়েক কানে ভেসে আসে রবীন্দ্রসংগীতের সুরে লো–ভল্যুমে ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক।
ইচ্ছে করে খানিকটা দাঁড়াই, একটু বসি, শুনি সে সুরের মূর্ছনা, দেখি আশপাশ। এক সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাব থেকে বেরিয়ে ভাগ্নে কুনালসহ ফুটপাতের উপর বসানো স্থায়ী বেঞ্চে বাদাম আর প্রচুর দুধ–চিনি দিয়ে বানানো কফি খেয়েছিলাম। উদ্দেশ্য কেবল এদিক–ওদিক দেখা। মনে হলো আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে ফিরে গেছি। ভালো লাগে। একই দৃশ্য সিআরবি শিরীষ তলা, সার্কিট হাউসের আশপাশ। আমাদের সময় এইভাবে দিনে–দুপুরে–সন্ধ্যেয় প্রকাশ্যে রাস্তার উপর বা ফুটপাতের বেঞ্চে কোন মেয়ের সাথে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয়া, প্রেম করা– সে ছিল কল্পনারও বাইরে। আমাদের সময় বড় জোর নিউমার্কেটের ডায়মন্ড রেস্টুরেন্টের ভেতর পর্দা–টাঙানো কবুতরের খোপের মত ছোট্ট কামরায় পাশাপাশি বা মুখোমুখি বসে গল্পে মেতে ওঠা, নিচু স্বরে ভালোবাসার কথা বলা। সেখানে খুব যে বেশিক্ষণ বসা যেত তাও না। একসময় বেরসিক বেয়ারা এসে কোন জানান না দিয়ে ঝুলে থাকা পর্দা সরিয়ে হাজির হতো। অর্থাৎ তোমাদের টাইম আউট। যাই হোক –
দিন কয়েক আগে উদযাপিত হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজা। সরস্বতী পূজা যে এতো জাঁকজমক সহকারে বাংলাদেশে উদযাপিত হয় জানা ছিল না। ধারণা ছিল কেবল দুর্গা পূজায় নগরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকায় পূজা মণ্ডপ বানানো হয়। এবার দেখলাম সরস্বতী পূজাকে ঘিরে চট্টগ্রামে চোখে পড়ার মত জমকালো আয়োজন। পূজার আগের দিন গিয়েছিলাম দৈনিক আজাদী অফিসে। সেখান থেকে বের হয়ে দেখি গলির মোড়ে, রাস্তার কিছুটা অংশ দখল করে বড় সামিয়ানা টাঙানো হচ্ছে, গান বেজে চলেছে। জিজ্ঞেস করলে একজন বলেন, কাল সরস্বতী পূজা, তাই। পুজোর দিন সন্ধ্যেয় প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম। কথা ছিল সেখান থেকে ধারে–কাছের একটি রেস্তোরাঁয় বসে খানিক আড্ডা ও খাওয়া–দাওয়া হবে। সাথে ছিলেন এক সাংবাদিক বন্ধু। তার এক পরিচিত বন্ধুও ছিলেন সাথে। জামালখান এলাকায় পৌঁছুতেই দেখি প্রচুর ভিড়– মহিলা, তরুণ–তরুণীদের প্রাধান্য বেশি। বেশ–ভুষায়, অনেকের মাথায় সিঁদুর, হাতে কাঁখা দেখে বুঝে নিতে অসুবিধে হয়না এরা সনাতনী ধর্মাবলম্বী। অবাধে চলাচল করছেন। চারিদিকে উৎসব–উৎসব ভাব। খাস্তগীর স্কুল থেকে জে এম সেন হল– এইটুকু রাস্তার দুপাশে ফুটপাত ধরে এগিয়ে চলেছেন ওনারা সবাই। যেন ‘অল রোডস লিড টু জে এম সেন হল’। সেখানে মাঠে ১১–টি সংগঠন এক–হয়ে আয়োজন করেছে সম্মিলিত সরস্বতী পূজা। ভালো লাগে চট্টগ্রামের বুকে এমন উৎসবমুখর পরিবেশে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে দেখে। দেখলাম, হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনের, বিশেষ করে মহিলাদের অনেকটা অবাধ ও নির্ভীক চলাচল। এর দিন কয়েক আগে হাজারি লেইন গিয়েছিলাম।
সিনেমা প্যালেসের দিক হয়ে ঢুকে বের হয়েছিলাম লালদীঘির দিকে। সেখানেও দেখলাম বিশেষ করে মহিলাদের, অবাধ হেঁটে চলা, কেনাকাটা করা। দূর থেকে অর্থাৎ ইউরোপে বসে ধারণা করতে পারিনি দেশে এসে এমন দৃশ্য দেখবো। সেই জন্যে শুরুতে লিখেছিলাম, দূর থেকে যা দেখে মনে হয় মন্দ, কাছে এসে দেখা যায় উল্টো। মনে হলো অনেকদিন পর সুন্দর, ধর্মীয় সমপ্রীতির এক নগর দেখছি। মনে মনে বলি নাসিরনগর, রামুর ধর্মীয় সহিংসতা নির্বাসনে যাক। সবার মাঝে জেগে উঠুক অসামপ্রদায়িক চেতনা। নানা ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ পাশাপাশি হেঁটে চলেছে, গোটা এলাকা উৎসবমুখর, নির্বিঘ্নে সবাই ঘুরে–বেড়াচ্ছে। দেখে আমার ভেতরটায় এক অজানা ভালোলাগায় পেয়ে বসে। যেন এ নূতন করে জেগে উঠা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভালো থাকলে দূরে থেকেও আমাদের ভালো লাগে। বাংলাদেশ রক্তাত্ত হলে আমাদেরও রক্তক্ষরণ হয়।
তবে আমি পূজাকে ঘিরে বিরাজমান পরিস্থিতি যেভাবে দেখছি বা যা মনে করছি, ঠিক তেমনটি মনে করেন না এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে আছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর। রানাদাকে চেনেন না এমন ব্যক্তি খুব কমই আছেন। তার সাথে আমার জানাশোনা অনেক দিনের। তিনি আশির দশকের শুরুতে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছিলেন। তাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম তিনি দেশের ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে কিভাবে দেখেন, কী তার অভিমত। কিছুটা দ্বিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘ভীতির সংস্কৃতি এখনো দেশে রয়েছে। এবারের সরস্বতী পূজার সময় নেত্রকোণায় মণ্ডপ ভাঙচুর হয়েছে। নেতিবাচক রাজনৈতিক ধারা, আওয়ামী লীগের গোঁড়া ধর্মীয় গোষ্ঠীকে তোষামদ করে রাজনীতি করা, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ চিন্তাশক্তির নুইয়ে পড়া ইত্যাদি কারণে এই সমস্ত দুঃখজনক ঘটনা এখনো ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে বলে তিনি জানালেন।
একটু ভিন্নভাবে বললেন প্রদীপ কুমার দাশ। সুদর্শন ও সুবক্তা, পড়াশুনা জানা বলে তার নাম রয়েছে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা। তিনি বলেন, এটি সত্যি দেশে এখনো সামপ্রদায়িক শক্তির উত্থান হচ্ছে। ভারতেও হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে অসামপ্রদায়িক চেতনা ধারণ করেনা। দুঃখের সাথে তিনি বলেন, বিরোধী দল যদি অসামপ্রদায়িক চেতনা নিয়ে রাজনীতি করতো, তাহলে তাদের সাথে এক হয়ে সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়া যেত। দেশে গণতন্ত্র প্রসারিত হতো। কথা বললাম নগরীর এক সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যবসা–বাণিজ্য, সরকারি চাকরি সহ নানা ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। সরকার সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সচেষ্ট।
তবে যে যাই বলুক আমি আশাবাদী। যে স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, যে অসামপ্রাদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্যে বঙ্গবন্ধু লড়েছেন, সেই লক্ষ্যার্জন যারা মনে করেন একেবারে অসম্ভব তাদের দলে আমি নই। আমার বিশ্বাস হাতে গোনা কিছু উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ছাড়া বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণ ধর্মীয় সমপ্রীতিতে বিশ্বাস করে। তা না হলে ভিন্ন বিশ্বাসে বিশ্বাসী জনগণ পাশাপাশি বসবাস করতে পারতেন না। যারা এই বিশ্বাসে ‘অবিশ্বাসের বীজ‘ বপন করতে চাইছে, করছে, তাদেরকে শক্ত হাতে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোন গত্যান্তর নেই। বাংলাদেশকে যারা আফগানিস্তান বানাবার পাঁয়তারা করছে তাদের সম্মিলিতভাবে, জাতি–ধর্ম–গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশকে রুখে তেমন শক্তি নেই। লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট