পাঠ্যবই গুজব-সন্ত্রাস ও বিতর্ক মুক্ত থাকুক

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

এটি সর্বজনবিদিত যে, সৎ সাংবাদিকতাঅবাধ সংবাদ প্রবাহ সমাজসমৃদ্ধিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পক্ষান্তরে অপসাংবাদিকতামিথ্যাচারপ্রতারণার মোড়কে বৃহত্তর সহজসরল জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করার দৃষ্টান্তও নেহায়েত কম নয়। যেকোন জাতিরাষ্ট্রে অপকৌশলের বেড়াজালে মিথ্যার বেসাতি সাবলীল ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি কলুষিত করে। প্রতিহিংসাপরশ্রীকাতরতা নানামুখী অপচেষ্টায় এমন কদাচার পরিবেশ তৈরি করে যাতে সর্বাধিক স্থিতিশীল সরকারকেও বহুধাবিভক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হয়। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামরক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা ও দেশ পুনরুদ্ধারের সামগ্রিক কর্মযজ্ঞেও নন ইস্যুকে ইস্যু বানানোর চক্রান্তষড়যন্ত্র জাতি দীর্ঘ সময় অবলোকন করেছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নির্দয়নিষ্ঠুর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কলঙ্কিত সেনাস্বৈর শাসক পরিচালিত সরকারের কদর্য অধ্যায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। বিগত প্রায় ১৪ বছর বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আকাশচুম্বী অর্জনকে ম্লান করার কুৎসিত দূরভিসন্ধি দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতাঅন্তরায় তৈরিতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে।

দেশবাসী অবশ্যই অবগত আছেন, দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্ধকারের পরাজিত শক্তির সকল অশুভ তৎপরতাকে নিধন করে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে বিশ্বপরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেল অভিধায় মর্যাদাসীন হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশকে অস্থিতিশীল করার কথিত আন্দোলন সংগ্রামে জনসম্পৃক্ততা প্রকাশে ছোট বড় বিপক্ষ দলের প্ররোচিত প্রচারণা পাঠ্যপুস্তক নিয়েও উত্থাপিত। দৃঢ়চেতাপ্রজ্ঞা ও মেধার অভূতপূর্ব সমন্বয়ে বিশ্বস্বীকৃত সফল ও সার্থক সরকার প্রধান হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ পবিত্র জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যের এক প্রশ্নের জবাবে অত্যন্ত জোরালো কন্ঠে বলেছেন, ‘ব্যর্থতা থাকলে খুঁজে দিন, সংশোধন করে নেব।’ জনকল্যাণ নিশ্চিতকল্পে নিখাঁদ দেশপ্রেমিক সৎবিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়কের এমন উচুমার্গের কন্ঠস্বরে উচ্চকিত বক্তব্য তাঁর সততাদক্ষতাযোগ্যতাকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করে। অতিসম্প্রতি পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যেসব আলোচনাসমালোচনা বিপুল প্রচারিত; সত্যবস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে তার যৌক্তিক যাচাইবাছাই অতীব জরুরি।

বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে আধুনিকযুগোপযোগী শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের শুরুতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন কারিকুলামের এবং অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পুরোনো শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে। বছরের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত বই উৎসবে বিতরণকৃত বিভিন্ন শ্রেণির বেশকিছু পাঠ্যবইয়ে কৃতিত্ব ছাড়া অন্যের লেখাইতিহাস বিকৃতি করে তথ্যমুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদের প্রাধান্যবিতর্কিত তত্ত্বইসলামবিরোধী ছবি ও লেখা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুসহ আরও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি অনুসন্ধানী পাঠ্যবইয়ে হুবহু অনুবাদের অভিযোগে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত তর্কবিতর্ক পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভুলের বিষয়টি ছাড়াও প্রশ্ন উঠেছে বইয়ের ছাপার এবং লেখকদের লেখার মান নিয়ে। অনভিপ্রেত এ ঘটনায় বিভিন্ন মহল সারাদেশে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে।

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে চলমান সমালোচনা এবং বিতর্র্ক অনেকাংশে একপেশে হলেও, বিতর্কের শীর্ষ স্থানে আছে ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে সংযুক্ত ডারউইনের তত্ত্বের বিষয়টি। যেখানে আদিম মানুষকে একবারও বানর নয়; বরং প্রাচীন মানুষ এবং সামাজিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে তুমুল বিতর্কের ঝড় ওঠে। জাতীয় সংসদ অধিবেশনেও চলেছে এর সমালোচনা। ইসলামিক বক্তারা ওয়াজ মাহফিল, এমনকি জুমার নামাজের খুতবায়ও বিষয়টি উপস্থাপনে পাঠ্যবই থেকে এটি বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অভিযুক্ত লেখকদের এবং ভুলভ্রান্তির বিষয়ে ইতিমধ্যে সংশোধনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে, ভুলের বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। যারা ভুল করেছেন এবং প্লেজিয়ারিজমের সাথে জড়িত তাদের আগামীতে পাঠ্যপুস্তক এবং সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত করা হবে না। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই এবার পরীক্ষামূলকভাবে দেয়া হয়েছে। এ বছর মাঠপর্যায়ে সবার মতামতের পর ব্যাপক পরিমার্জন করে আগামী বছর দেওয়া হবে বইগুলোর প্রথম সংস্করণ। নবম দশম শ্রেণির বইয়ে যেসব ভুল রয়েছে তার সংশোধনী ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি অনলাইনে এবং এনসিটিবির ওয়েবসাইটেও দেয়া হয়েছে যেখানে সারা দেশের সব প্রতিষ্ঠানের সংযুক্তি রয়েছে।

১৭ জানুয়ারি ২০২৩ গণমাধ্যম সূত্রমতে, সপ্তম শ্রেণির ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটিতে উৎস উল্লেখ না করেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে গুগল ট্রান্সলেটরে হুবহু অনুবাদ করে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার দায় স্বীকার করে রচনা ও সম্পাদনায় সম্পৃক্ত থাকা শিক্ষকগণ এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘একটি পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে অনেকে জড়িত থাকেন, যাদের শ্রম ও নিষ্ঠার ফল হিসেবে বইটি প্রকাশিত হয়। বিশেষত জাতীয় পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে এসব লেখকের কাছ থেকেই এক ধরনের দায়িত্বশীলতা আশা করা হয়। সেখানে কোনো একজন লেখকের লেখা নিয়ে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তা আমাদের টিমের জন্য হতাশার এবং মন খারাপের কারণ হয়। ঐ অধ্যায়ের আলোচিত অংশটুকু লেখার দায়িত্বে আমরা দুজন না থাকলেও সম্পাদক হিসেবে এর দায় আমাদের উপরও বর্তায়, সেটি আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি। অবশ্যই পরবর্তী সংস্করণে বইটির প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করা হবে। এ বছর বইটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ চালু হয়েছে এবং সামনের শিক্ষাবর্ষ থেকে এতে যথেষ্ট পরিমার্জন ও সম্পাদনার সুযোগ রয়েছে। কাজেই উল্লেখিত অভিযোগের বাইরেও যেকোনো যৌক্তিক মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হবে এবং সে অনুযায়ী পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হবে।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বইয়ের মধ্যে লেখা কারও নিজের তা কেউ দাবি করেনি বিধায় এটাকে চৌর্যবৃত্তি বলা যাবে না। তবে উৎস উল্লেখ না করাটা ভুল ছিল।’

প্রাসঙ্গিকতায় সম্মানিত শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘নতুন পাঠ্যবইয়ে ভুল সংশোধন করা হবে। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের সব বইয়ের পরীক্ষামূলক সংস্করণ ছাপানো হয়েছে। আমরা পরবর্তী সংস্করণে প্রয়োজনীয় সংশোধন করবো।’ ৩০ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বর্ণপদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি সরকারের নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তক না পড়েই মিথ্যাচার করার অভিযোগ এবং যুক্তিযুক্ত ভুল কেউ ধরিয়ে দিলে সংশোধন করা হবে বলেও মন্তব্য করেন। পাঠ্যবইয়ের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে তা সংশোধন এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সাত সদস্যের উচ্চপর্যায়ের দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

আমাদের সকলের জানা, দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের সংকট সমাধানে জননেত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার অতিগুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ২০০৯ সালে বিনামূল্যে বই বিতরণের অত্যন্ত সাহসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ বছর সরকার ২৯৬ কোটি ৭ লাখ টাকার পাঠ্যপুস্তক প্রদানের উদ্যোগ নেয় এবং ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি এটি প্রথম উদ্বোধন করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে একদিনে বিপুলসংখ্যক বিনামূল্যে বই দেওয়ার কার্যক্রম দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বেশ প্রশংসিত ও সমাদৃত।

শিক্ষার হার উন্নীতকরণ, জীবনমান উন্নয়ন, আপামর জনগোষ্টীর সকলকে একীভূত শিক্ষা প্রণোদনার সুদূরপ্রসারী ধ্যান ধারণা থেকেই বিনামূল্যে বই বিতরণ দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণকে অধিকতর শক্তিশালী করবে। শিশুকিশোরদের মধ্যে বই বিতরণ উৎসব শুধু অনুপ্রেরণাউদ্দীপনার সঞ্চারক নয়; দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে পর্যাপ্ত জ্ঞানশিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার অভিনব পন্থা হিসেবেও বিবেচ্য। ২০৪১ সালে ‘ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে এরাই হবে আমাদের যোগ্যতম উত্তরসূরী। আমাদের সকল দুর্বলতাগুলো সংহার করে আগামী দিনের বাংলাদেশকে আধুনিকযুগোপযোগী বিশেষ করে চতুর্থপঞ্চম শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় তারাই হবে দক্ষপ্রশিক্ষিতগুণী কারিগর। পরিশুদ্ধ শিক্ষা কার্যক্রমনির্ভুল পাঠ্যপুস্তকযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, উন্নত গবেষণালব্ধ জ্ঞান সৃজনউৎপাদনবিতরণের পরিশিলীত ও উপযুক্ত সামগ্রিক শিক্ষা পরিবেশ তৈরিতে সংশ্লিষ্ট সকলেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্লোভনির্মোহ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালনে ব্রতী হবেনএটিই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে একরাতে ৭ লাখ টাকা দামের চার গরু চুরি