হলুদ ট্রাংকে তরুণীর লাশ আর একটি জিডি

৬ বছর পর খুনের রহস্য উন্মোচন, খুনি গ্রেপ্তার

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

হাসপাতালের মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট শম্পা বেগম নৌ কর্মকর্তা রেজাউল করিম স্বপনের সাথে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কে জানত, শেষ পর্যন্ত প্রেমিকের হাতে মৃত্যু হয়ে তাকে অজ্ঞাতনামা লাশ হিসেবে দাফন হতে হবে?
পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অনুসন্ধানে দীর্ঘ ছয় বছর পর উদঘাটিত হলো অজ্ঞাতনামা লাশটি ছিল শম্পা বেগমের। ধরা পড়েছেন তার প্রেমিক রেজাউল করিম স্বপন। স্বীকার করেন, ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে মনোমালিন্য হলে শম্পাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন স্বপন।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে আজাদীকে বলেন, পিবিআই এ ঘটনাটি দুই বছর ধরে তদন্তের পর অবশেষে সাফল্যের মুখ দেখেছে। অজ্ঞাত সেই নারীর পরিচয় শনাক্তসহ ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত তার প্রেমিক স্বপনকে শুক্রবার ভোরে কুমিল্লার ইপিজেড এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামি হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। নিহত তরুণী শম্পা বেগম খুলনার দৌলতপুর থানার দেওয়ানা উত্তরপাড়ার ইলিয়াস শেখের মেয়ে।
২০১৫ সালের ৩ মে সকাল ৯টার দিকে নগরীর এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কেটে এক ব্যক্তি একটি হলুদ ট্রাংক তুলে দেন বাসের বঙে। হেলপারকে বলেন, ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে ওই টিকিটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরের কাউন্টার থেকে যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে গাবতলী পৌঁছায়। এরপর বাসের সব যাত্রী তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়। ট্রাংকটি দেখতে পান বাসের হেলপার। ড্রাইভার ও হেলপার মিলে ট্রাংকটি নামিয়ে দেখেন খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুস সালাম থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে ট্রাংকটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ দেখতে পায়। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পরে নাম-পরিচয় খুঁজে না পাওয়ায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে লাশটি দাফন করা হয়। এই ঘটনায় দারুস সালাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহানুর আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে ২০১৫ সালের ৩ মে একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি দারুস সালাম থানা পুলিশ তিন মাস তদন্ত করে। পরে তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দেওয়া হয়। চার বছর তদন্ত করে সিআইডি। কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত এবং হত্যা রহস্য কোনোটাই উদঘাটন করতে না পেরে মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে সিআইডি।
এই হত্যার রহস্য উদঘাটনের জন্য আদালত ২০১৯ সালে তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেন। পিবিআই ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে কাজ শুরু করে। পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ইউনিটের তদন্তকারী কর্মকর্তারা অজ্ঞাত নারীর পরিচয় শনাক্ত করতে সব ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এরপর চট্টগ্রাম শহর ও জেলা এলাকার সব থানায় ২০১৫ সালে নিখোঁজ জিডির অনুসন্ধান শুরু হয়। সেখানে ১০-১২টি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করা হয়। জিডিগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালের ১০ জুন তারিখের একটি জিডিতে (নং ৫৯৯) দেখা যায়, শম্পা বেগম চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ওই ঘটনায় নিহত শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় জিডিটি করেন।
ওই জিডির সূত্র ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তা জিডিকারী আব্দুল মান্নান ও নিহত শম্পা বেগমের বাবা ইলিয়াস শেখের (অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ২০১৩ সালে রেজাউল করিম স্বপন (অবসরপ্রাপ্ত নৌ বাহিনী সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌ ঘাঁটিতে কর্মরত থাকাকালীন শম্পা বেগম একটি হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্টের কাজ করতেন। ওই হাসপাতালে ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসার সুবাদে শম্পার সঙ্গে রেজাউলের পরিচয় হয়। পরিচয়ের এক পর্যায়ে প্রেম হয়। পরে শম্পা বিয়ের জন্য চাপ দিলে রেজাউল বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন। শম্পাও কিছুদিন পর চট্টগ্রামে তার এক ফুফুর বাসায় চলে আসেন। এরপর ফয়’স লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন তারা। তারপর পাহাড়তলী থানাধীন একটি আবাসিক এলাকায় একটি টিনশেড বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে সাবলেট হিসেবে বসবাস শুরু করেন দুজনে। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত বসবাস করেন। দুজনে বিয়ে না করলেও পরিবারকে জানান তারা বিয়ে করেছেন।
দুজনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় মনোমালিন্য দেখা দিত। ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে মনোমালিন্য হলে শম্পাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন স্বপন। এরপর আসামি লাশ গোপন করতে একটি ট্রাংকে ভরে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের বাসে তুলে দেন। শম্পার বাবাকে তিনি জানান, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাসে তুলে দেওয়ার পর দুদিন টিভি-পত্রিকা মনিটর করেন স্বপন। কিন্তু কোথাও সেভাবে কোনো সংবাদ না আসায় তিনি নিশ্চিত হন, এটা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা হবে না।
এদিকে শম্পা বাড়ি না পৌঁছায় বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। শম্পার পরিবারের পাশাপাশি খোঁজ করতে থাকেন স্বপন নিজেও। না পেয়ে পাহাড়তলী থানায় একটি জিডি করেন শম্পার ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান। শম্পার বাবা ২০১৫ সালের ২৭ মে আসামি রেজাউল করিম স্বপনের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। স্বপনের বিষয়ে তার বাহিনী তদন্ত করে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০১৯ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। এরপর তিনি কুমিল্লায় চলে যান। অবশেষে ছয় বছর পর পিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে আসামি রেজাউল করিম স্বপন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’
পরবর্তী নিবন্ধবিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে স্মরণ