হযরত শাহজাহান শাহ (রা.) তাসাউফ আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র

ড. এ. এস. এম. বোরহান উদ্দীন | বুধবার , ২১ অক্টোবর, ২০২০ at ৯:১২ পূর্বাহ্ণ

জাগতিকতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, কূপমন্ডুকতা, স্বার্থ, কাম, বিভিন্ন প্রকারের কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ যখন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তখনই মানবাত্মাকে ঐশী পথে পরিচালিত করার নিমিত্তে মহান আল্লাহর অনুগ্রহে যুগ যুগ ধরে নবী রসুল হাদী, সুফি, আউলিয়ায়ে কেরামগনের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা মানবাত্মাকে মহান আল্লাহর আনুগত্য ও প্রেমময়তায় উদ্বুদ্ধ করে মিলন পথে পৌঁছে দেন। সুফিয়ায়ে কেরাম তথা আউলিয়ায়ে কেরামগণ পবিত্র ইসলামের আলোকবর্তিকা হাতে বিশ্ব জগতের রন্ধ্‌্ের রন্ধ্‌্ের পৌঁছে সত্য, সুন্দর, কল্যাণ, শৃঙ্খলা ঐক্য, প্রগতি সাম্য মৈত্রী ভালবাসার এক অনুপম বন্ধন সৃষ্টি করেন।
দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে সুফিয়ায়ে কেরামের আগমন নির্গমন ঘটে। বাংলাদেশে সুফিবাদের সূচনাকাল একাদশ শতকে। ইসলাম অধ্যুষিত পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং উত্তর ভারত থেকে মধ্যযুগীয় বাংলায় শত শত সুফি-দরবেশ বাংলাদেশে আগমন করেন। কালক্রমে সমগ্র বাংলাদেশে এমনকি গ্রামীণ জনপদেও সুফিবাদের বিস্তৃতি ঘটে। এর ধারাবাহিকতায় যে ক’জন ক্ষণজন্মা আউলিয়ায়ে কেরাম চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধর্ম প্রচার ও জনকল্যাণে ব্রতী হন তাদের মধ্যে হযরত শাহজাহান শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম। সূর্যের আলোয় গহীন অন্ধকার যেভাবে মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায় তেমনি এ মহান অলিয়ে কামেলের পদচারণায় সাম্য, মানবতা, শিক্ষা, প্রেম-মমতার এক স্নিগ্ধ কিরণে সমকালীন সমাজ মানস ও জীবন হয়ে উঠে উদ্ভাসিত।
হযরত শাহজাহান শাহ রহ. এমন এক পবিত্র আলোকবর্তিকা যিনি ত্যাগ, সাধনা, দৃঢ়তা, মজবুত মানসিক অবলম্বন ও আত্মোৎকর্ষ লাভের মাধ্যমে সুফিবাদের সর্বোচ্চ স্তর তথা বিভিন্ন উচ্চ উন্নত স্তরে পৌছুতে সক্ষম হয়েছিলেন। যিনি ‘জিন্দা অলি’ নামে আখ্যাত হন। যা কুতুবুল আকতাব হজরত গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারীর ক. একাধারে সাতদিন তাঁর মাজার প্রাঙ্গনে অবস্থান এবং শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ক. (তাঁর সম্পর্কে) পবিত্র মন্তব্যে সুপ্রমাণিত।
হযরত শাহজাহান শাহ রহ. এমন এক ইনসানে কামেল যাঁর রওজা জিয়ারতে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়, মন হয় পবিত্র। তিনি প্রেম ও অবলীলামুক্ত অন্তরে প্রাপ্ত ঐশ্বরিক প্রেরণার সত্যস্বরূপ-সৌন্দর্য্যস্বরূপ। যিনি ভক্তের মন ভক্তিরসে ভরে দেন ও তাঁর মন হতে কলুষ কালিমা বিদুরিত করে আল্লাহর মিলন ঘটান। মহানবীর ভাষায়: ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার, যে এ পরিবারের সদস্যদের প্রতি ভাল, সে আল্লাহর নিকট ভালো’। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগোষ্ঠী তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির অফুরন্ত স্বর্গীয় আভায় উদ্ভাসিত। পর্যায়ক্রমে তাঁর মাজার প্রাঙ্গন সম্প্রীতির এক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। মনোবাসনা পূরণ করার জন্য তিনি সবাইকে দয়া করেন। সবার মধ্যে খোদা প্রেমের বীজ বপন করেন।
মানুষের পাশাপাশি মূক জন্তু জীন, বণ্যপ্রাণী পশু পাখিও তাঁর প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রকাশ করে যথাযথ মর্যাদায়। তাঁর মাজার শরীফ অতিক্রমকালে হাতি, উট ইত্যাদি প্রাণীও যথার্থ সম্মান ভক্তি প্রদর্শন করে থাকে। এমনকি হিংস্র ব্যঘ্র তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুল মোবারক লেহন করতো। শুধু যে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কাছে আসতো এমনটি নয় তাঁর ওফাতের পরও তাঁর মাজার প্রাঙ্গনে শ্রদ্ধা জানাতে আসতো। বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বিষয়টি বিবৃত হয়েছে। নিম্নোক্ত পংক্তিমালায় বিষয়টি ফুটে ওঠে এভাবে:
নহে শুধু ইনসান, পাখ-পাখালী-স্বাপদ- হাইওয়ান,
সকল প্রাণীর, সকল প্রাণের অপরূপ এক মিলন স্থান
হযরত শাহজাহান শাহের স্মৃতিঘেরা এই সবুজ চাট্টান।
হযরত শাহজাহান শাহ রহ. এমন এক মানব কল্যাণকামী মনীষী যাঁর জীবন মানবতার জন্যই নিবেদিত। জীবদ্দশায় যেমন ছিলেন তেমনি ওফাতের পরও তিনি মানবকল্যাণে নিবেদিত। তাইতো দুঃখী, নিরন্ন, অসহায় বঞ্চিতদের ফরিয়াদে যথার্থ সাড়া মেলে তাঁর দরবার থেকে। বিশেষত অত্যাচারিতের প্রতি একেবারে জীবন্ত মানুষের মতোই সংবেদনশীল তাঁর দরবার। ফকির আহমদ চৌধুরীর স্বপ্নে বৃষ্টি হতে দেখে রাত্রে পুকুরে মাছ ধরার ‘চাঙ্গ বসানোর জন্য বের হলে হযরত শাহজাহান শাহ রহ. কে সামনে ৪টি বাঘ এবং পেছনে দুটি বাঘ নিয়ে ভ্রমণ করতে দেখা, রাতের আঁধারে হারিকেন দিয়ে উক্ত ফকিরকে পথ দেখানো, মরহুম কোরবান আলী চৌধুরীর বার্মা থেকে আসার পথে পুরং পাহাড়ে ডাকাত দলের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া, বিভিন্ন ব্যক্তির মামলা থেকে খালাস পাওয়া, দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া ইত্যাদি তাঁর পবিত্র কারামাত ও সংবেদনশীলতার উজ্জল উদাহরণ। হযরত শাহজাহান শাহের (রা.) মানব সেবাকে স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম ও নিষ্ঠারূপে বিবেচনা করেছেন। রুমীর ভাষায়-‘মানুষের চিত্ত জয় করাই মহত্তম তীর্থযাত্রা।’ এক কথায় তাঁর আদর্শ ছিল ‘খিদমতে খালক’ বা সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন। হযরত শাহজাহান শাহকে রহ. আবর্তিত করে যে জীবন প্রবাহ, তার মূলেও রয়েছে মানবতার কল্যাণ তথা কুল মাখলুকাতের মঙ্গল। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার পরশ, অতিন্দ্রীয় সহযোগিতা ও তাঁর আদর্শের অনুবর্তী নি:স্বার্থ, স্বেচ্ছাসেবী ত্যাগী, সৎ, ও মানবহিতৈষী ব্যক্তিবর্গের কর্মতৎপরতা ও প্রাণচাঞ্চল্যে গড়ে উঠেছে জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের এক অনবদ্য কাঠামো।
সৃষ্টির প্রতি হযরত শাহজাহান শাহ’র রহ.্‌ ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম। আল্লাহর ওলীদের রূহানী ফয়েজ ওফাতের পরও জারি থাকে তাইতো জীবিত অবস্থায় যেমন তেমনি ওফাতের পরও সমভাবে সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁর মাজার শরীফ হাজার হাজার ভক্তের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হচ্ছে। এখানে সর্বস্তরের মানুষ এসে যে নজর নেয়াজ, হাদিয়া পেশ করেন সেগুলোও কল্যাণকর একাধিক শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ব্যয় করা হচ্ছে। তাঁর মানবহিতৈষী চিন্তাধারার আলোকে গড়ে উঠেছে ‘হযরত শাহজাহান শাহ রহ. এতিমখানা। রোগাক্রান্ত দুস্থ মানবতার সেবার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়ে আসছে দাতব্য চিকিৎসা সেবা। এলাকার শিশুদেরকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ফোরকানয়িা মাদ্রাসা আর উচ্চতর জাগতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় হযরত শাহজাহান শাহ (রা.) এবতেদায়ী মাদ্রাসা। দেশের মেধাবী দুস্থ ছেলেদেরকে পবিত্র কোরান হেফজের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) হেফজখানা। এলাকার জ্ঞানপিপাসু আবাল বৃদ্ধ ছাত্র-শিক্ষক সর্বস্তরের লোকের জ্ঞানার্জনে সহায়তা করার জন্য ইসলামী জ্ঞানসহ আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভে সহযোগিতার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) ইসলামী পাঠাগার প্রকল্প। এছাড়া মাজার শরীফকে কেন্দ্র করে যে নানা কর্মযজ্ঞ প্রতিপালিত হয়ে আসছে। অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোমলমতি সন্তানদের শিক্ষার আলো প্রজ্জলিত করার নিমিত্তে হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) স্যাটেলাইট প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দানের লক্ষে স্বল্প শিক্ষিত বেকার যুবকদের বেকারত্ব দূরীকরণ, আর্থিক সমৃদ্ধি সাধন হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.)এর ভক্ত আশেক ও সকল তরীকতপন্থী লোকেরা যেন সম্মিলিতভাবে জিকির মাহফিলে অংশগ্রহণপূর্বক আত্মার উন্নতি সাধন করতে পারে সেজন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) দায়রা শরীফ । হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) মসজিদ প্রকল্প, হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) মাজার শরীফ প্রকল্প, হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) পুকুর ও ঘাট, হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) মার্কেট, হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) গেইট প্রকল্প, আগন্তুক ভক্ত জায়েরীন ও এতিমখানাসহ সর্বস্তরের মানুষের পবিত্রতা অর্জনের জন্য হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) গণশৌচাগার নির্মাণ, হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভাণ্ডারীর আসন শরীফ সংরক্ষণ ও মিনারা নির্মাণ, গাড়ির জন্যে অপেক্ষমান যাত্রীদের ক্লান্তি দূরীকরণ ও রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষায় যাত্রী ছাউনি নির্মাণ, এলাকাবাসীর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান মাজার শরীফের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা, বাগান বৃক্ষরোপণ প্রকল্প ইত্যাদি। হযরত শাহ জাহান শাহ (রা.) মাজার শরীফ কমপ্লেক্স পরিচালনা পরিষদ আশেক ভক্তদের দান হতে পাওয়া টাকা দিয়ে কেনা ৪৫ শতক জায়গা যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মানবতার কল্যাণে দান করেন। সেই জমিতে সরকার হযরত শাহ্‌জাহান শাহ (রা.) নামে দশ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করছেন। যা গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ কাজ শুরু করেছেন । এই কাজের টেন্ডার হয়েছে ৪ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা।
মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও সার্বিক কল্যাণে হযরত শাহজাহান শাহ’র (রা.) ছিলেন সত্যিকার অর্থে এক আলোকবর্তিকা । তার সত্যাসন্ধ আদর্শ, কল্যাণ, কাশফ, আধ্যাত্মিকতা, কর্মপ্রক্রিয়া, অপূর্ব চরিত্র মাধুরী সর্বোপরী ঈমানী মহিমায় এ অঞ্চলের মানুষ সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। সমাজ রাষ্ট্র ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সৃষ্টি করেছিলেন আলোড়ন। ভক্তদের হৃদয়ে আশা, সাহস ও আস্থার অনির্বাণ প্রদীপরূপে তাঁর মাজার শরীফকে আবর্তিত করে যে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা, মানবসেবা মূলক কর্মধারা প্রবর্তিত হচ্ছে তা আমাদের সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নে সহায়ক হবে। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবনে ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : সভাপতি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমোখতার আহমদ : মুক্তির মিছিলের দীপ শিখা