হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.)

আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ | বৃহস্পতিবার , ৩০ জুন, ২০২২ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

সোনার গাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহর সেনাপতি কদলখান গাজির সহায়তায় হজরত পীর বদরুদ্দীন আল্লামা তাঁর সহচরদের নিয়ে মগদস্যুদের পরাস্ত করে চট্টগ্রাম জয় করলে এখানে ইসলামী শাসনের সূচনা হয়। কথিত আছে যে খ্যাতনামা বারোজন সূফীসাধক ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। চট্টগ্রামস্থ সীতাকুন্ড থানার সোনাইছড়ি অঞ্চলে যা পরবর্তীকালে ‘বার আউলিয়া’ নামে সর্বত্র প্রচারিত ও প্রকাশিত তথায় তাঁদের আস্তানা দৃষ্ট হয়।

কোন এক সময় কাদেরীয়া তরীকার প্রবক্তা প্রখ্যাত সূফী সাধক গাওসুল আজম হজরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (র.) এর বংশধর ভারতের বিহারে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মরমীবাদের ব্যাপক প্রচারণা খোদা প্রেমিক পুরুষদের হৃদয়ে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, ফলে বড়পীর ছাহেবের বংশোদ্ভূত ত্যাগী পুরুষ শাহ সূফী আমানত (র.) বিহার শরীফের নিজ পিত্রালয় ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জগতের আকুল ইশারায় আত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর কাশ্মীরের পথে চলে যান। এখানে এসে তিনি উপযুক্ত মুর্শিদের খোঁজ করতে থাকলেন অত্যন্ত নীরবে। কাশ্মীরের জনৈক বুজর্গ ব্যক্তি তাঁকে ঐ সময়ের মহান অলী হজরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর সন্ধান বলে দেন।

তাঁর কাছে জানতে পারলেন আবদুর রহিম শহীদ (র.) ঐ সময় লক্ষ্মৌ অবস্থান করছেন। অতঃপর হজরত লক্ষ্মৌ এসে জানতে পারলেন, মাত্র অল্পকাল হলো তিনি মখসুসাবাদ চলে গেছেন। এর পর হজরত এল্‌ম মারিফাতের অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ্মৌ থেকে মখসুসাবাদে এসে পৌঁছলেন। অতঃপর প্রেমাস্পদ তাঁর প্রিয়তমের সন্ধান পেলেন। হজরত শহীদ (রহ.) এর করুণা দৃষ্টি তার’ পরে নিপতিত হলো। মুর্শিদ কেবলা হজরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর কর চুম্বনের মাধ্যমে হজরত শাহ আমানত (রহ.) এল্‌ম মারিফাতে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সান্নিধ্য পেয়ে হজরত অত্যন্ত গৌরবান্বিত হলেন। মাত্র অল্পকাল মধ্যে তিনি মুর্শিদের সাহচর্যে থেকে এল্‌ম বাতেন শাস্ত্রে চরমোৎকর্ষতা লাভ করে অফুরন্ত নেয়ামত হাসিল করলেন। পীর ছাহেব বুঝতে পারলেন শাহ আমানতের অন্তর আল্লাহ প্রেমের জোয়ারে পরিপূর্ণ এবং রাব্বুল আলামীনের সাথে মিলনাকাংখায় মন তাঁর উন্মুখ। এমন এক প্রেমাস্পদের সন্ধান পেয়ে মুর্শিদ অত্যন্ত আশান্বিত হলেন। একান্ত মনোযোগের সাথে তাঁকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দান করতে থাকেন। হজরতের ঐশী ক্ষমতার ব্যাপকতা দর্শন করে মুর্শিদ কেবলা তাঁকে কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া-মুজাদ্দেদীয়া এবং মাদারীয়া তরীকায় খেলাফত প্রদান করতঃ বিবাহিত জীবন যাপনের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করার উপদেশ দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় শহর চট্টগ্রাম যেতে নির্দেশ দিলেন। ১১২০ হিজরী সনে হজরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) তদীয় ভ্রাতুষ্পুত্র হজরত নাজিমুদ্দীন কে নিয়ে মখাসুসাবাদ ত্যাগ করে ঢাকা তশরীফ নিয়ে এলেন। এখানে এসে তিনি লক্ষ্মীবাজারে একটি খানকাহ স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর খানকাহটি ‘মিয়া ছাহেবের ময়দান’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

চট্টগ্রামের আত্মিক জগতের কর্তৃত্বের ভার গ্রহণ করে শাহ সূফী আমানত খান (র.) অত্যন্ত ধন্য হলেন। এদিকে চট্টগ্রাম শহরে এসে তিনি সরওয়ারে কায়েনাত হজরত মুহাম্মদ মোস্তাফা (স.) এর সুন্নত পালনার্থে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে স্থানীয় আদালতে সামান্য একটি চাকরি জুটিয়ে নিলেন। (ঐ সময়কার নবাবী আমলের আদালতটি পরবর্তীকালে মোহসেনিয়া মাদ্রাসা এবং তারও পরে মহসিন কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।) অতঃপর দিনের বেলায় হজরত আদালতের কাজে এবং রাত্রি বেলায় আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যাপৃত হলেন। পার্থিব জগতের মায়া মমতা তাঁকে আর গৃহাভিমুখী করতে পারলো না। আদালতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এবাদত বন্দেগীর জন্যে একটি নিরিবিলি স্থানের খোঁজ করছিলেন। অতঃপর একদিন আন্দরকিল্ল্লা পাহাড়ের পাদদেশে হজরত পীর বদরুদ্দিন আল্লামার মাজার শরীফের কিছুটা পশ্চিমে বদর পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি নিরিবিলি স্থান নির্বাচন করে তথায় তিনি খানকাহ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ঐ স্থান ‘খানকাহ আমানতিয়া’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

জাগতিকতার আবরণে চাকুরীর ছদ্মবেশে হজরত দিনের বেলা আদালতে কাজ করতেন এবং রাত্রি বেলা আধ্যাত্মবাদের কঠোর সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। মৌনপন্থী ছিলেন বিধায় সাধারণ মানুষ তাঁকে চিনতে পারেননি। কিন্তু অসহায় মানুষের মনোবেদনা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। এক মাহেন্দ্রক্ষণে এক চরম অসহায় ব্যক্তিকে মামলার দলিলপত্র সংগ্রহে সাহায্য করতে গিয়ে জন সমক্ষে তাঁর আধ্যাত্মিক আভরণ প্রকাশ পেয়ে যায়। রুমাল দিয়ে নৌকা বানিয়ে চোখের পলকে দুর্গম সুমদ্রের শত মাইল পথ সংকুচিত করে মুহূর্তের মধ্যে মামলার কাগজপত্র সংগ্রহের অত্যাশ্চর্য্য ঘটনার কিংবদন্তি আজও বংশ পরম্পরায় চট্টগ্রামবাসীর মুখে মুখে উচ্চারিত।

হালাল পন্থায় উপার্জন তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্টের পরিচায়ক। সমাজ পতিদের ধন দৌলতের গর্বকে তিনি আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ঐশী ক্ষমতার বলে অগ্নিস্নাত করে দিয়েছিলেন। প্রায় সময় তিনি নীরবতা অবলম্বন করতেন বলে তাঁর চরিত্রের এক বিরাট অধ্যায় অজ্ঞাত রয়ে গেছে। নিজের কোন প্রকার প্রচারণাকে তিনি প্রাণভরে ঘৃণা করতেন। তাঁর কাছে আদবের অত্যন্ত সমাদর ছিলো কিন্তু বে-আদবকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দিতেন না।

হজরতের একমাত্র ঔরশজাত পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খানকে খানকাহ শরীফ এবং নিজ বসতবাড়ীর তদারকীর ভার ন্যস্ত করে এই মহিমামন্ডিত সূফী তাত্ত্বিক হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) ১১৮৭ হিজরী সনের জেলক্বদ মাসের শেষ রাত্রে খানকাহ্‌ শরীফে ইন্তেকাল করেন।

এতদঞ্চলে হজরতের অসংখ্য মুরীদ এবং খলিফা ছিলেন। তৎমধ্যে ঢাকাস্থ আজিমপুর দায়রা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত বুজর্গ হজরত শাহ সূফী মুহাম্মদ দায়েম (র.), মিরসরাই মাস্তান নগরস্থ হজরত শাহ সূফী কেয়ামুদ্দীন (র.) এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাইলধর গ্রামের হজরত শাহ সূফী মিয়া হাজী দৌলত (র.) হজরতের অন্যতম খলিফা ছিলেন।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ওশখাইন দরবার শরীফের প্রখ্যাত সূফী কবি হজরত আলী রেজা (র.) তদীয় রচিত জ্ঞানসাগর নামক কাব্যগ্রন্থে নিজেকে হজরত কেয়ামুদ্দীন (র.) এর মুরীদ এবং হজরত কেয়ামুদ্দীন (র.)কে হজরত শাহ আমানত খান (র.) এর মুরীদ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশের মুসলমান হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, সকলেই তাঁর পবিত্র রওজা শরীফে মনের আকুতি নিবেদন করে। শাহ সূফী আমানত খান (র.) তাই সাধারণ মিয়া ছাহেবের গন্ডি পেরিয়ে এখন একজন ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তা। তাঁর রওজা শরীফে খুশবুদার রঙ্গিন গিলাফ মোড়ানো মকবরার সৌরভে মাতোয়ারা হয়েছে ভক্তকুল। যিনি যত বেশী প্রেমিক তিনি তত বেশী রূহানী ফয়েজ লাভ করতে পারেন। হজরতের ভক্তরা তাঁর পবিত্র ওরশ শরীফে এসে অসীম শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে রোদন করতে থাকেন। এমন একদিন ছিলো যেদিন তিনি হাকিম ছাহেবের পাখা টেনে টেনে দিনাতিপাত করতেন। আজ তিনি অসহায় দুঃখপীড়িত ভক্তবৃন্দের পোড়ামনে শান্তির পাখা টেনে বেহেস্তের সুখ দান করে চলেছেন।

জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যে কোন পর্যায়ের মনস্কামনা পূরণের উছিলায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ,নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর জন্যে অহোরাত্র অবারিত এই সার্বজনীন দরগাহ শরীফ। দেশি বিদেশী পর্যটকগণ চট্টগ্রাম সফরে এলে তাঁর রওজা শরীফ দর্শন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন। শতাব্দীকাল ধরে এখানে হজরতের ভক্তদের জন্যে দু’বেলা লঙ্গর চালু রয়েছে। শহর চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে উল্ল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা তাঁর পূণ্যস্মৃতি বহন করে চলেছে। এর মধ্যে সবিশেষে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী সড়ক পথের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জন্যে নির্মিত শাহ আমানত হল এবং আকাশ পথে চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) এর একমাত্র পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খান তদীয় পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং নিজ পরিবারের ভরণ পোষণের নিমিত্তে ১১ই বৈশাখ ১২০২ মঘী একখানা ব্যক্তিগত ওয়াক্‌ফ নামা সম্পাদন করেন। উক্ত ওয়াক্‌ফনামায় তিনি স্বীয় দুই পৌত্র যথাক্রমে আলিয়ার খান এবং আমানত খানকে উক্ত ওয়াক্‌ফ এস্টেটের মুতওয়াল্ল্লী নিযুক্ত করেন। (আনোয়ার খানের একমাত্র পুত্র আলেফ খান পিতার জীবিত কালেই ইন্তেকাল করেন)। ওয়াক্‌ফ নামায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে তাঁর পৌত্রদ্বয়ের ইন্তকালের পরে তাঁদের পুত্রগণ এবং পরবর্তীকালে পৌত্র পৌত্রাদি পুরুষানুক্রমে বংশ পরম্পরায় মুতওয়াল্ল্লী হিসাবে গণ্য হবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণমানুষের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল