হজরত শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দি (রহ.)

আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ | বৃহস্পতিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৪২ পূর্বাহ্ণ

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) এর সুযোগ্য বংশধর হজরত ইমাম রফিউদ্দীন (রহ.) এর আওলাদ হজরত মখদুম আবদুল আহাদ সিরহিন্দি (রহ.) এর ঔরসে হিজরী ৯৭১ সনের ১৪ই শাওয়াল শুক্রবার এই উপমহাদেশে নক্‌শবন্দিয়া তরীকার মহান বুজর্গ হজরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শরীফে জন্ম লাভ করেন। যে সমস্ত মহা পুরুষ কালের প্রবাহে নিজেদের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের দ্বারা, জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক কর্মকান্ডের ফলে, সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার এবং বেদআত সমূহের মূল উৎপাটন করে মানুষের কল্যাণ সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানীর নাম প্রণিধানযোগ্য।

হজরতের জন্মের পূর্বে তদীয় পিতা একদিন মুরাকাবা অবস্থায় অবলোকন করলেন, জগতের পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত নিকষ কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে এবং নানাবিধ হিংস্র শাপদ মানুষের নিশ্চিহ্ন করে চলেছে। সেই মুহূর্তে তাঁর বুকের মধ্যখান থেকে একটি উজ্জ্বল আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত করে ফেলে। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন ঐ আলোর ভিতর থেকে একটি সিংহাসন বের হয়ে এলো, তথায় উপবিষ্ট এক জোতির্ময় মহাপুরুষ। তাঁর সামনে অত্যন্ত নম্র এবং আদবের সাথে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বেহেস্তী লোক এবং ফিরিস্তাকুল। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, উক্ত বুজর্গ তাঁর হস্তস্থিত লাঠির আঘাতে মানুষ হত্যাকারী শাপদদের পিটিয়ে মারছেন আর উচ্চ শব্দে ঘোষণা করছেন, সত্যের আবির্ভাব ঘটেছে ও মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে।

হজরতের এই স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে দিলেন দতীয় মুর্শিদ কেবলা কাদেরীয়া তরীকার অন্যতম বুজর্গ হজরত শাহ কামাল কায়থলি (রহ.)। তিনি তাঁকে এমন এক পুত্র সন্তানের সুসংবাদ প্রদান করলেন যার দ্বারা সমস্ত শিরক এবং বিদ্‌আতের মূল উৎপাটন হয়ে পৃথিবীর বুকে শান্তি ফিরে আসবে এবং নবীর সুন্নাত প্রতিষ্ঠিত হবে।

হজরতের জন্মের পরে তদীয় বুজর্গ পিতা মুরাকাবা হালতে দেখতে পেলেন, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (.) ছাহাবী এবং ফিরিস্তা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তথায় তশরীফ নিয়ে এলেন এবং বাচ্চার ডান কানে আজান ও বাম কানে একামত শুনিয়ে নাম রাখলেন ‘আহমদ’। সেই থেকে হজরতকে উপস্থিত সবাই আহমদ নামে ডাকলেন। অত্যন্ত অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন হেফ্‌জ করেন। পিতার কাছে এল্‌ম শরিয়তের প্রাথমিক পাঠ সমাপন করে শিয়ালকোটের প্রখ্যাত আলেম কামাল উদ্দীন কাশ্মিরীর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। এরপরে তিনি মুহাদ্দিস শায়খ এয়াকুব কাশ্মিরীর কাছে বিভিন্ন হাদিস রপ্ত করে সনদ লাভ করেন। এর পরে কাজী বদখশানীর কাছে তাফসীর, ফিক্‌হ ও আদব শিক্ষা গ্রহণ করে সনদ লাভ করেন। এভাবে ভারতবর্ষে এলম শরীয়ত এর পণ্ডিতরূপে সমাদৃত হলেন।

হজরতের পিতা ছিলেন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত তরীকা সমূহের একজন কামালাত প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। এল্‌ম শরীয়ত এর পাঠ শেষ হলে তদীয় বুজর্গ পিতা হজরতকে চিশতীয়া, কাদেরীয়া এবং সুহরাওয়ারদীয়া তরীকার মুরীদ করেন এবং তাঁর অসাধারণ নৈপূণ্য দেখে তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন। হজরত মখদুম আবদুল আহাদ সিরহিন্দি (রহ.) ১০০৭ হিজরী সনের ১৭ই রজব ৮০ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

পিতার বেসালতে হাকিকী লাভের পরে হজরত পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে দিল্লী এসে স্বীয় বন্ধু হজরত হাসান কাশ্মিরী (রহ.) এর আতিথ্য গ্রহণ করেন। বন্ধুর মুখেই শুনেন সদ্য কাবুল প্রত্যাগত নক্‌শবন্দীয়া তরীকার স্বনামধন্য বুজর্গ হজরত খাজা মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ (রহ.) এর নাম। এই মহান সাধকের নামের মধ্যে এতই আকর্ষণ শক্তি ছিলো যে, হজরত শায়খ আহমদ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। বন্ধু সমভিব্যবহারে তিনি হজরত খাজার দরবারে এসে পৌঁছলে হজরত তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে কিছুকালের জন্যে মেহমান হওয়ার অনুরোধ জানালেন। অত্যন্ত আগ্রহ চিত্তে তিনি হজরত খাজার আতিথ্য গ্রহণ করে সপ্তাহকাল অবস্থানের আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ইতোমধ্যে হজরত খাজা ইস্তখারা ব্যতীত হজরতকে নক্‌শবন্দীয়া তরীকায় মুরিদ করেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই হজরত শায়খ আহমদ নক্‌শবন্দীয়া তরীকার কামালাত ও ফইউজাত এর বন্যায় নিজেকে সমাহিত করে প্রেম সাগরে ডুবে রইলেন। নক্‌শবন্দীয়া তরীকায় অসাধারণ উন্নতি লাভের ফলে মাত্র তিন মাসের মধ্যে হজরত এই তরীকার মাকামাত সমূহ সফলভাবে অতিক্রম করে নিসবত লাভ করলে বাকী বিল্লাহ (রহ.) খাজা হজরতকে খেলাফত প্রদান করেন। দ্বিতীয়বার তিনি পীর ছাহেবের সান্নিধ্য লাভার্থে দিল্লী তশরীফ নিয়ে এলে হজরত খাজা যুগশ্রেষ্ঠ এই মুরিদের অভ্যর্থনার জন্যে বুলন্দ দরওয়াজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মুর্শিদ কেবলা খাজা বাকী বিল্লাহ বলেছেন, ‘শায়খ আহমদ সিরহিন্দির হাতে এ তরীকার আমানত সমূহ সোপর্দ করতে পেরে আমি দায়মুক্ত হয়েছি’। তিনি তদীয় মুরিদদের বলতেন, ‘যদি তোমরা তোমাদের ঈমানের নিরাপত্তা কামনা করো তবে শায়খ আহমদ সিরহিন্দর নম্রতা, আদব ও আজিজির প্রতি খেয়াল রেখো। তিনি রূহানী জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বরূপ। তাঁর নূরে তেজস্ক্রীয়তার সামনে আমাদের মতো শত সহস্র তারকা নিষপ্রভ ও অস্তিত্বহীন বটে’।

হিজরী ১০১০ সালের ১০ই রবিউল আউয়াল একদিন মুরাকাবার হালতে হজরত দেখতে পেলেন রসুলে আকদস্‌ (.) তথায় তশরিফ এনে একখানা মহামূল্যবান পোশাক তাঁকে পরিয়ে বললেন, মুজাদ্দেদ আল্‌ফেসানীর পোষাক এটাই। একদা হজরতের লাহোর অবস্থানকালীন সময়ে প্রখ্যাত আলেমে দীন মাওলানা জামাল উদ্দীন তিল্‌ভী ও মাওলানা আবদুল হাকিম শিয়ালকোটি হজরতের কাছে মুরিদ হয়ে যান এবং তাঁর কর্মের অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে মুজাদ্দেদ আল্‌ফেসানী সম্মানে ভূষিত করেন।

তৃতীয়বার হজরত দিল্লী আগমন করলে তদীয় মুর্শিদ কেবল হজরত খাজা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, ঐ সময় হজরত শায়খ আহমদ বহুল প্রশংসিত কাইউমিয়ত এর স্তরে উপনীত হয়েছেন, তাই তিনি অত্যন্ত নম্রতার সাথে মুরিদের ন্যায় তাঁর সামনে বসে রইলেন। বেলায়েত এবং নবুয়তের মধ্যখানে কাইউমিয়তের স্তর। কাইউম হচ্ছে মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামিনের এমন একজন সম্মানিত খলিফা যার আধ্যাত্মিক প্রতিবিম্বের পরিধির অন্তর্ভুক্ত সমস্ত কুতুব। আওতাদরা তাঁর কামালিয়ত এর বেষ্টনীভুক্ত। কাইউমের স্তরে পৌঁছার দরুন হজরতের উপর যে সমস্ত মারিফাত প্রকাশ লাভ করেছে সেগুলো চার ভাগে ভাগ করা যায়।

. মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরীফের মুকাত্‌তাআত ও আয়াতে মুতাশাবেহাতের ব্যাখ্যা যা তিনি কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেননি।

. ঐ সমস্ত মারিফাত যা তিনি তদীয় কামালিয়ত প্রাপ্ত পুত্রগণ ব্যতীত অন্য কারো কাছে প্রকাশ করেননি।

. ঐ সমস্ত গুপ্ত বিষয় যা তিনি তদীয় মুরিদগণের নিকট অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে বর্ণনা করেছেন।

. ঐ সমস্ত মারিফাত যা তিনি সূফীগণের শিক্ষা লাভের নিমিত্তে পুস্তাকাকারে বা মকতুবের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

একদিন জোহর নামাজান্তে হজরত শায়খ আহমদ (রহ.) পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শুনছিলেন, এমতাবস্থায় অন্তদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলেন সরওয়ারে কায়েনাত হজরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (.) তশরীফ এনে একটি মহা মূল্যবান তাজ তাঁকে পরিয়ে দিয়ে কাইউমিয়ত পদ লাভের জন্যে মোবারকবাদ জানালেন।

হজরতের রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মুকতবাত শরীফ, মাবদা ও মাআত, মাআরিফে লাদুন্নিয়া, মুকাশিফাতে আয়নিয়া, ইস্‌বাতুন নবুয়ত এবং তাহলিলিয়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হজরতের কঠোর কঠিন আন্দোলনের কারণেই মহাপরাক্রমশালী আকবরের দীনইলাহীর কবর রচনা হয়েছিল এবং নেশাগ্রস্থ সম্রাট জাহাঙ্গীরের তওবা নসীব হয়েছিলো। এরপর পরই ধার্মিক শাহজাহান এবং বুজর্গ আরওঙ্গজেবের আবির্ভাব হয়ে ভারতবর্ষে ইসলামী শাসন কায়েম হয়েছিলো।

হজরত শায়খ আহমদ ফারুকী মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) ৬৩ বৎসর বয়সে হিজরী ১০৩৪ সনে ২৭শে সফর এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে আল্লাহ্‌পাকের দরবারে উপনীত হন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণে : জ্ঞানতাপস অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র সিংহ
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম