স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম এ শহরের মুক্তিযোদ্ধারা

কুমার প্রীতীশ বল | সোমবার , ১১ মার্চ, ২০২৪ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাএসব বুঝার আগে আমার দেখা প্রথম মুক্তিযোদ্ধা আমাদের পাশের বাড়ির নটুদা। এরপর আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি, ঘোরাফেরা করেছি, মতবিনিময় করেছি। কিন্তু আমার মুক্তিযোদ্ধা নটুদা ছিল এ শহরের সবার চেয়ে আলাদা। দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। নটুদার কোনো স্বপ্ন ছিল না। কেন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তাও জানে না। যুদ্ধ থেকে নটুদা ফেরার সময় একটা ‘কিরিচ’ নিয়ে এসেছিল। ওটার কোনো ব্যবহার কোনোদিন দেখেনি। ‘কিরিচ’ রাখার কারণে নটুদা রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছিল। তখনও নটুদার কোনো দুঃখবোধ ছিল না। নিরক্ষর নটুদার কোনো চাকরি ছিল না। আমার মায়ের জোড়ালো সুপারিশে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা সুকুমার সর্ববিদ্যা, জগদীশ সিংহ প্রমুখরা তাঁকে কানুনগোপাড়া বাসের হেলপারের চাকরি দেয়। নটুদা অতঃপর নিজের যোগ্যতা আর একাগ্রতায় বাসের ড্রাইভার হয়ে যায় অল্প কয়েক বছরের মধ্যে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নটুদার কোনো সনদপত্র ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা নম্বরও নেই। পাওয়ার চেষ্টাও করেনি। কোনো আক্ষেপও দেখিনি। কিন্তু তাঁর সাহস ছিল অসীম। শক্তিও ছিল। এই সাহস আর শক্তি পরবর্তীকালেও এ শহরের সব মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে দেখেছি। এ জায়গায় সবার মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের তাৎপর্য্যও উপলব্দি করি।

ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ির সময়ে পরিচিত হয়েছি মোছলেম উদ্দিন, মাঈনুদ্দীন খান বাদল, সোলায়মান কমান্ডার, আহমদ হোসেন, আবুল হোসেন, অমল নাথ, এস.এম. সেলিম, রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী, মাহাবুব প্রমুখ অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। মাহাবুব ভাই মাথায় সাদা গান্ধী টুপি পড়তেন। তাই কেউ কেউ টুপি মাহাবুব, আবার কেউ কেউ গান্ধী মাহাবুব ডাকতেন।

এ শহর আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়েছে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইদ্রিছ। মাহাতা ইদ্রিছ নামে সমধিক পরিচিত। ইদ্রিছ ভাই অন্যদের চেয়ে আমার কাছে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। ইদ্রিছ ভাই বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলে কিংবা কোনো লেখার প্রয়োজন হলে ভোরবেলায় বাসায় এসে হাজির হতেন। যা লিখে দিতাম, তাই নিয়ে ছুটতেন। ইদ্রিছ ভাইয়ের কোনো কিছুতে ধৈর্য্য থাকত না। সময় দিতেন না। বসার মধ্যে লিখিয়ে নিতেন। লেখা শেষ হলে ধন্যবাদ দিয়ে ছুটতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের প্রতিবছর বৃত্তি দিতেন। এ উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করতেন। এসময় খুব ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর এ ব্যস্ততায় আমাকেও জড়িয়ে রাখতেন। বিশেষ করে লেখালেখির প্রয়োজনে। ইদ্রিছ ভাইয়ের বিয়ের কথা মনে পড়ে। শহর থেকে কয়েক বাস বরযাত্রী কঙবাজার গিয়েছিলাম। কক্সবাজার সৈকত মোটেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলেন। সে ছিল আমার প্রথম কক্সবাজার ভ্রমণ। বাস যাত্রীদের সবাই ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তাঁর বিয়েটা কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের একটা মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে ইদ্রিছ ভাই ছিলেন আপোষহীন। দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তখন আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি। এঁদের মধ্যে যদু গোপাল বৈষ্ণবের নাম স্মরণে আছে।

স্বগ্রামবাসী রণজিৎ রক্ষিতকে জানতাম শৈশব থেকে। আমাদের দু’জনের বাড়ির কয়েক মিনিটের ব্যবধান। তখন তাঁকে জানতাম নাট্যজন হিসেবে। এ শহর আমাকে জানিয়েছে রণজিৎ রক্ষিত ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ছিলেন। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ শহরে তাঁর পাশাপাশি থাকতেন মুক্তিযোদ্ধা অমল মিত্র। একাত্তরের দুর্ধষ মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের চট্টগ্রামে তাঁর হাত দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে তাঁর ভূমিকার কথা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন। অমল মিত্র বাবাকে দাদা ডাকতেন। তাই আমার ‘কাক’ু। রণজিৎ রক্ষিতকেও ‘কাকু’ ডাকতাম। একারণে তিনি এখন বোধন আবৃত্তি পরিষদে সবার ‘কাকু’।

এ শহরে আমার এক মুক্তিযোদ্ধা চাচা ছিলেন। তিনি মুহম্মদ ইদ্রিস আলম। আগরতলা মামলার আসামী মানিক চৌধুরীর ছেলে কাজল চৌধুরীও তাঁকে ইদ্রিস চাচা ডাকতেন। ইদ্রিস চাচা সবাইকে বলতেন, এ শহরে আমার দু’জন ভাতিজা আছে। আমাকে ভাতিজা ডাকার একটা কারণ ছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত চরচাক্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার কাকা প্রভাস রঞ্জন চৌধুরী। সে কারণে তিনি আমাকে ভাতিজা ডাকতেন। ইদ্রিস চাচার নিত্যসঙ্গী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বদন দিদারী। তাঁকেও চাচা ডাকতাম। নন্দনে আসলে অনেকক্ষণ গল্প করতেন। কামালখানকে কেন চাচা ডাকতাম এখন আর মনে নেই। মুক্তিযুদ্ধে কামালখানের অসীম অবদান আজ অনেকের অজানা। সোয়াত জাহাজ থেকে অস্র নামানোর প্রতিরোধ সংগ্রামে কামাল চাচারা সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার স্মরণিকা ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়’তে সোয়াত ৭১ নামে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথনের শ্রুতিলিখন করেছিলাম। এ স্মরণিকায় প্রকাশিত নৌ কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হারিস’র স্মৃতিচারণও শ্রুতিলিখন করেছিলাম। কামাল চাচা রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন। সে সূত্রে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।

এ শহরের আলোচিত উৎসব মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সান্নিধ্য লাভ করেছি। এক্ষণে মনে পড়ছে এম.. মান্নান, কাজী এনামুল হক দানু, জাফর আহম্মদ, আবুল হাশেম, আবদুল মোমেন ভুঁইয়া, মো. শাহ আলম, কাজী শাহজাহান, আবুল কাশেম চিশতি, দেওয়ান মাকসুদ, সন্তোষ ধর, পিনাকী দাশ, মৃদুল গুহ, সাথী দাশ, পান্টু সাহা, পঞ্চানন চৌধুরী প্রমুখের কথা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত হাফিজ খান রুশ্নি ছিলেন ‘নন্দন’র নিত্য অতিথি। রুশ্মি ভাই যতক্ষণ থাকতেন দু’হাতে খরচ করতেন। নন্দন থেকে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছিল কোনো একুশের প্রথম প্রহরে। আমার অনুরোধে রুশ্মি ভাই বোধন আবৃত্তি স্কুলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত ক্র্যাস্ট স্পন্সর করেছিলেন। নন্দনএ আসতেন একাত্তরের শব্দসৈনিক মাহাবুব হাসান। তাঁর মুখে শুনেছি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার গল্প। ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিশান কেন্দ্র হতে প্রথমবারের মত স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত বার্তা পাঠ করেন। মেজর জিয়ার জন্য অপেক্ষার কথা, আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের মেজর জিয়াকে ধরে বেতার কেন্দ্রে আনার গল্পও তিনি নন্দনের আড্ডায় শুনিয়েছেন। বেলাল মোহাম্মদ মেজর জিয়াকে নাকি বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই মাইনর, আপনি একমাত্র মেজর। আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।’ একথা বলতে গিয়ে মাহাবুব ভাইও হাসলেন আমাদের সঙ্গে। এ শহরে একাত্তরের আরও শব্দসৈনিক আছেন। তাঁদের মধ্যে জয়ন্তি লালা, অজয় হোড়, দেব চৌধুরী, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, শেফালী ঘোষ, ননী গোপাল দত্ত, মিহির লালা, একেএম আসাদুজ্জামান, ফজল হোসেনের নাম স্মরণে আছে।

মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র বাসায় মোছলেম ভাইয়ের সঙ্গে কয়েকবার গিয়েছি, তবে পরিচিত ছিলাম না। বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়টা অনেক বেশি শাণিত ছিল। আমার বিয়ের অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিতি হয়েছিলেন। আবদুল হালিম দোভাষকে নিয়ে বিয়ে দাওয়াত দিতে গিয়েছিলাম। সে রাতে পাশে বসিয়ে ডিনার করেছিলেন।

এ শহরে দৈনিক আজাদী সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে দেখেছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বৈদেশিক সম্প্রচার দপ্তরে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশের ৩২ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সম্মানিত সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর বাকশালের চট্টগ্রাম উত্তর জেলার গভর্নর ছিলেন।

অধ্যাপক পুলিন দে প্রবীণ রাজনীতিবিদ। ধুতি আর খদ্দের পরতেন। মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান ছিল। দেখা হলেই কুশলাদি জানতে চাইতেন। পুলিন দে বলুয়াদিঘীতে গ্যাস চুল্লী উদ্বোধন করার দিন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর রসিকতা এখনও মনে পড়ে। মেয়র বলেছিলেন, শশ্মানের চুল্লী উদ্বোধন করতে লাশ দরকার। আমি মুসলমান আমাকে চুল্লীতে দেওয়া যাবে না। তাই পুলিন দাকে ঠিক করলাম। পুলিনদা অট্টহাসি দিয়ে বললেন, তোরাই তো আমাকে শশ্মানে নিবি।

বঙ্গবন্ধু ভবনের জামাল উদ্দিন, শামসুদ্দিন বর্দ্দা, কফিলউদ্দিন, সিরাজ মিয়া, আবু সালেহ, জানে আলম, এস.এম.ফারুক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এ শহুরে উত্তাপ ছড়াতে পেরে আজও গর্বে বুক ফুলে ওঠে।

এ শহরে শহিদ জায়া বেগম মুশতারি শফির ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনে সরব উপস্থিতি মনে থাকবে। তাঁর সঙ্গে পত্রযোগাযোগ হয়েছিল। তখন চিঠি লেখা অন্যতম শখ ছিল।

এ শহরে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাঁদের স্মৃতিচারণ শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলায়। এখানে ওখানে পড়েছি, দেখেছিও অনেককে। তাঁদের কথা অসমাপ্ত রয়ে গেল। ভাবিকালের গবেষকরা এসব বীরগাথা লিখে আমার অপূর্ণতার শোধ দেবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবার এলো যে সন্ধ্যা
পরবর্তী নিবন্ধ‘জ্ঞান চৌতিশা’র কবি আশক্ল্লর আলী পণ্ডিত