স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল আমার বাবা বিমলেন্দু বড়ুয়া

অন্তি বড়ুয়া | শুক্রবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে /অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার/ যায় চরে আলোকে/ পুরাতনের হৃদয় টুটে/আপনি নূতন উঠবে ফুটে/জীবনে ফুল ফোটা হলে/ মরণে ফল ফলবে।’
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি প্রতিনিয়তই আমাকে খণ্ড-বিখণ্ডিত করে। জীবনে এই অনিবার্য সত্যের এমনিভাবে মুখোমুখি হতে হবে কোনদিন ভাবি নি। আমার ক্ষরিত হৃদয়ে সারাক্ষণ একটি শব্দই প্রতিধ্বনিত হয়, সে শব্দটি হচ্ছে-বাবা! আমার বাবা!
‘পিতাহ স্বর্গ, পিতাহ ধর্ম, পিতাহি পরমং তপঃ
পিতরে প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।’
বিশাল বটবৃক্ষের মতো যার শাখাপ্রশাখা অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, যার শিকড়-কাণ্ড মাটির গভীর তলদেশ পর্যন্ত প্রোথিত, যার ছায়ায় সুশীতল প্রশান্তি, আশ্রয়ে নিরাপদ মাথা গোঁজার ঠাঁই, জীবনের হাজারো ঝড়, বন্যা, সাইক্লোন ও কঠিন সমস্যার সুন্দর সমাধানদাতা, শান্তির একমাত্র আশ্রয়স্থল, অটল পাহাড়ের মতো সুউচ্চ, ঋজু, ধৈর্যশীল, সুবিশাল মহাসাগরের মতো যার ধারণক্ষমতা, পর নির্ভরতার প্রতীক অকৃত্রিম বন্ধু, অসীম, সুবিস্তৃত আকাশের মতো উদার-যিনি আমার অন্তরে সর্বক্ষণ জ্বলজ্বলে শুকতারার মতো দেদীপ্যমান তিনি আমার প্রাণপ্রিয় পিতা বিমলেন্দু বড়ুয়া।
বহুমুখী প্রতিভা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক অসম্ভব মেধাবী মানুষ আমার বাবা। কর্মজীবনে যেমন তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছিলেন, তেমনি ব্যক্তিজীবনেও নানামুখী কর্মকাণ্ডে, সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি বিনির্মাণে একনিষ্ঠ এবং এক বর্ণিল জীবনের অধিকারী ছিলেন। নির্মোহ পরিমিতিবোধ তাঁকে দায়িত্বশীল অভিভাবক, সুযোগ্য কর্তব্যনিষ্ঠ সন্তান ও জামাতা, স্নেহশীল ভাই, অকৃত্রিম বন্ধু, প্রেমময় স্বামী এবং পিতা হিসেবে অসম্ভব স্নেহপরায়ণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অথচ অন্ধ অপত্যস্নেহের মোহমুক্ত এক অসাধারণ ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।
অসম্ভব ধৈর্যশীল আমার বাবা পরম মমতায় সবসময় আমাদের সততা, সত্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, ধৈর্য আর একাগ্রতার অনুশীলন করাতেন। যাঁর শক্ত হাত ধরে কঠিন মাটির উপর উঠে দাঁড়িয়েছে তাঁকে দেখেছি নানা সময়ে নানা রূপে। কখনও গুরুগম্ভীর, কখনও হাস্যোজ্জ্বল, কখনও সদালাপী আবার কখনও গভীর ধ্যানী পুরুষ হিসেবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে বাবার অনির্বচনীয় বাণী অনুধাবন ও অনুসরণের চেষ্টা করি। তাঁর প্রেরণা, নীতিশিক্ষা, আদর্শবোধ আমাদের প্রতিটি ভাইবোনকে করেছে উজ্জীবিত। মহৎ জীবনাচরণ অনুসরণে করেছে উদ্বুদ্ধ। আমার বাবা-মা দু’জনেই ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য নিজেদের সমগ্র প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করেছেন। তেমনি পাশাপাশি ধর্মীয় নীতিশিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ এবং ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করার ব্যাপারেও সচেষ্ট থেকেছেন আজীবন। তাঁরা পুত্রসন্তান কিংবা কন্যাসন্তান এই বিভাজনে কখনও আমাদের বিভাজিত করেন নি। আমি চতুর্থ কন্যাসন্তান হওয়া সত্ত্বেও কলেজে পড়াকালীন শিক্ষাসফরে ভারত পাঠানো থেকে শুরু করে জীবনের কোন ইচ্ছাই তাঁরা অপূর্ণ রাখেন নি।
নানা ঘাত প্রতিঘাত, চরম প্রতিকূলতার মাঝেও আমার বাবার এই প্রতিষ্ঠার শিখরে ওঠা, সাংবাদিকতার টেবিলে অতন্দ্র প্রহরীর মতো শত বিনিদ্র রজনী জাগার পরও অমর সাহিত্যরস সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখা, আবার সমাজ-সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিরলস শ্রম দেওয়া, দেশেবিদেশে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করা এবং স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত হওয়া-এসব কিছুর পেছনে ছিল আমার মা অমিতা বড়ুয়ার অপরিসীম ত্যাগ আর সহযোগিতা। বড় কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না আমার মায়ের কিন্তু তাঁর মতো জ্ঞানী, দূরদর্শী, হৃদয়বান, পতিবতা ও আদর্শ নারী আমার দৃষ্টিতে বিরল। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কখনও তাঁর মধ্যে কোন অহংকার ছিল না বরং সবাইকে পরম মমতায় আপন করে নেওয়ার পাশাপাশি বাবার সমস্ত কর্মকাণ্ডে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন আন্তরিকতার সাথে।
আমার বাবার মায়ামমতা ও স্নেহের ফল্গুধারা বইত হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে। চট্টগ্রাম থেকে যখন ঢাকায় আসতাম তখন আমাদের পিতাপুত্রীর বিদায়লগ্নে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেন। স্মিত হাসিটি ধরে রাখার চেষ্টা করে আমাকে কান্না থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। শেষ চুমুটি বাবা আমাকে দিয়েছিলেন মৃত্যুর তিন মাস আগে জাপান যাওয়া প্রাক্কালে আর আমি আমার প্রাণপ্রিয় বাবাকে শেষ চুমুটি দিয়েছিলাম মৃত্যুর বিশ মিনিট আগে এ্যাপোলো হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে। তখনও আমি বুঝতে পারি নি আমার জীবনের সমস্ত আনন্দ, সমস্ত প্রাপ্তি, সমস্ত ঐশ্বর্য, সমস্ত প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে আমার জীবনটাকে চরম অপূর্ণতায় ভরে দিয়ে আমার বাবা অনন্ত নির্বাণপথের পথিক হয়ে চলে যাচ্ছেন। আর কখনও এই দৌদ্রহাওয়ার পৃথিবীর বুকে আমার প্রাণপ্রিয় বাবার সাথে দেখা হবে না এই কথা ভাবতেই হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যায়। মৃত্যুর অমোঘ নিয়মকে মেনে নিলেও আমি একটা প্রশ্নের উত্তর কখনও খুঁজে পাই না-সর্বক্ষণ আমার বাবাকে আগলে রেখেও দুর্ঘটনার দিন কেন আমার বাবাকে যমরাজের হতে তুলে দিলাম? কেন আমি আমার বাবার সফরসঙ্গী হলাম না? নিজেকে কখনও আমি ক্ষমা করতে পারব না। আমৃত্যু এই বৃশ্চিকের দংশনে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবেই।
‘আমি ভোরের স্বপ্নে দেখেছি তোমারে’-দুর্ঘটনার দিন সকালে বাবা আমাকে পরম আবেগভরা কণ্ঠে গানটি গেয়ে শোনালেন। জানতে চাইলেন জগন্ময় মিত্রের এই গানটি আমার কাছে আছে কি না। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে গান গাইতে বসলে দুটি গান তিনি গাইতেনই- ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মোছায়ে’ এবং ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা আমাদেরই এই বসুন্ধরা’। জাপান থেকে আসার পর যে তিনদিন তিনি প্রাণচঞ্চল ছিলেন সেই তিনদিনই তিনি গুনগুন করে গেয়েছেন-‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।’ তাঁর এই অবচেতন মনের স্বপ্ন পূরণের জন্যই যেন তিনি দেশমাতৃকার কোলে ফিরে এসেছিলেন।
অনন্ত পথের পথিক আমার বাবা বেঁচে আছেন, থাকবেন তাঁর বিশাল সৃষ্টিসম্ভারের মাঝে, অগণিত অনুরাগীর হৃদয়ের মণিকোঠায়। সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে তিনি আজ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত যার স্বীকৃতিস্বরূপ অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদকসহ আরও বিভিন্ন অভিধা ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন।
বাবা, এখন আমার কোন প্রাপ্তিই পূর্ণতা পায় না। যখন খুব কষ্ট পাই, একা লাগে তখন তোমার কাছেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। আমি চোখ বন্ধ করে তোমাকে স্মরণ করি। আমার নিঃশব্দ আাকাশে তখন একটি নক্ষত্র আলো ছড়ায় সেই নক্ষত্রটি তুমি-বাবা! আমার বাবা! ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সাগরে তুমিই সেই আলোর বাতিঘর। তোমার দেখানো পথ ধরে আমি চলেছি দূর দিগন্তের দিকে…
লেখক : সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়ার মেয়ে

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাধারণের ভেতর থাকে অসাধারণত্বের আনন্দ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা